মেহেরপুর গাংনী উপজেলার ভাটপাড়া গ্রামের যুবক তুহিন আলী। বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তান। দেশে একটি কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছিলেন তিনি। তুহিনের আয়ের উপরই চলতো তার পরিবারের ব্যায়ভার।
সংসারের আর্থিক সচ্ছলতা আনতে বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে স্থানীয় দালাল রাজুকে ৫ লাখ টাকা দিয়ে ২ মাস আগে গেছেন মালেশিয়া। সাহেবনগর গ্রামের জাহিদ মেলেটারির ছেলে আদম পাচারকারির দালাল রাজু যুবক তুহিন আলীকে ভাল বেতনে কোম্পানীর কাজ দেওয়ার কথা বলে নিয়ে যান মালেশিয়ায়। তুহিন আলীকে কোম্পানির কাজ না দিয়ে তাকে দিয়েছে সাপ্লাই ভিসা। কাজ না দিয়ে তাকে রাখা হয়েছে একটি মানব ক্যাম্পে। যেখানে তিন মাস ধরে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে তুহিন। তুহিনের মত তিন শতাধিক যুবক এখন ওই ক্যাম্পে আটক রয়েছে।
তুহিন আলী মোবাইল ফোনে জানান, মালয়েশিয়া আসার পর কয়েকজন লোক নিয়ে যায় রাজধানীর কুয়ালালামপুরের সালাক সালাতান নামের একটি মানব ক্যাম্পে। সেখানে আমার মত তিন শতাধিক যুবক বন্দি রয়েছে। তুহিনের ওই ক্যাম্পে থাকা অন্যান্য যুবকরা জানান, আমরা ৫/৬ মাস আগে এখানে এসেছি। আমাদেরও এই ক্যাম্পে আটক রাখা হয়েছে। এদের মধ্যে অনেকেই এসকল দালালের মাধ্যমে সহায় সম্বল বিক্রি করে চার মাস আগে মালেশিয়া গিয়েও আটকা পড়ে আছে এই মানব ক্যাম্পে।
তারা ভিডিও বার্তায় বলেন, আমরা বেশ কয়েক মাস যাবৎ এই ক্যাম্পে আটকা আছি। শুধু তুহিন নয়, এই ক্যাম্পে আটকা আছে। গাংনী উপজেলার কল্যাণপুর গ্রামের আজমত আলীর ছেলে লাঁলচাদ ইসলাম, সে সাহেবনগর গ্রামের আদম পাচারকারি সুরজ আলীর মাধ্যমে ৫ লাখ টাকা দিয়ে ৩ মাস আগে গেছেন মালেশিয়াতে।
কাজিপুর গ্রামের গোলাম বাজার এলাকার বজলুর ছেলে মাজেদ মাস্টারের হাতে ৫ লাখ টাকা দিয়ে মালেশিয়া যান কাজিপুর গ্রামের কাদের হেলালের ছেলে আনারুল ইসলাম। তিনি জানান, শুধু আমি নয়, মাজেদ মাস্টারের হাত ধরে এলাকার ৩ শতাধিক যুবক মালেশিয়া এসেছেন। সকলের ভাগ্যে জুটেছে একই অবস্থা।
মোহাম্মদ পুর গ্রামের ইয়ারুল ইসলামের ছেলে জমিরুল ইসলাম মালেশিয়া গেছেন সাহেবনগর গ্রামের দালাল আব্দুল্লাহর মাধ্যমে। তার কাছ থেকে নিয়েছে ৫ লাখ টাকা। জমিরুল ইসলাম জানান, প্রায় ৫ মাস আগে মালেশিয়াতে আসলেও এখন পর্যন্ত কোনো কাজ দেয়নি। সাপ্লাই ভিসা দিয়ে এখন আটক রেখেছে এই ক্যাম্পে। আমরা এখানে মানবেতর জীবন যাপন করছি। এখানে খাওয়া নেই, পানি নেই। ছোট্ট রুমে গাঁদাগাদি, ঠাসাঠাসি করে রেখেছে। কিছু বললে হত্যার হুমকি দিচ্ছে দালাল চক্র।
মুজিবনগর উপজেলার পুরন্দরপুর গ্রামের বাহাদুর আলী বলেন, আমি গাংনী উপজেলার কাজিপুর গ্রামের আদম পাচারের দালাল নাড়া মেম্বরের মাধ্যমে ৫ লাখ টাকা দিয়ে মালেশিয়া এসেছি।
আমরা প্রায় ৪ মাস এই মানব ক্যাম্প আটকা পড়ে আছি। আমরা খাওয়া অবানে মারা যাবো। আবার বাড়িতেও ঋনের কিস্তি। কথা বললে হত্যার হুমকি দিচ্ছে। এভাবেই ৪ মাস যাবৎ দুর্বিসহ জীবন যাপন করছি আটেেক পড়া ক্যাম্পে।
শুধু, তুহিন, বাহাদুর, আনারুল, জমিরুল বা লালচাদ ইসলাম নয়, ওই ক্যাম্পে আটকা পড়ে আছে প্রায় ৩ শতাধিক যুবক। পরিবারের সচ্ছলতা ফেরাতে জমি জমা বিক্রি, ঋণ, ধার দেনা বা কর্জ করে দালালদের মাধ্যমে হেছেন, মালয়েশিয়ায়।
একমাত্র সম্বল ভিটে মাটির বিক্রি করে তারা জনপ্রতি ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা তুলে দিয়েছেন।মালয়েশিয়া গেলেও আকামা (কাজের অনুমতিপত্র) না পাওয়ায় কর্মহীনভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা।
জানা গেছে, দালাল চক্রটি তাদেরকে অন্যত্র বিক্রি করায় কাজ না পেয়ে খাবার পানি সংকটে ভুগছেন। সেইসঙ্গে প্রতিনিয়ত দেয়া হচ্ছে প্রাণনাশের হুমকি। তাদের বন্দি থাকা এ সকল ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে।
মালয়েশিয়ায় থাকা ভুক্তভোগীদের কয়েকজন জানান, স্থানীয় গাংনী উপজেলার সাহেবনগর গ্রামের কেএনএসএইচ বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের লাইব্রেরিয়ান শিক্ষক মাজেদ মাস্টার, কাজীপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক ইউপি সদস্য শরিফুল ইসলাম ওরফে ন্যাড়া, বালিয়াঘাট গ্রামের আনিসুল হক মাস্টারের ছেলে শোভন, সাহেবনগর গ্রামের সুরজ ও তার ভাই আওয়াল এবং ইন্জিনিয়ার মুসা কলিমের মাধ্যমে ঢাকায় নাভিরা ও মুসাকলি এন্টারপ্রাইজ এজেন্সির মাধ্যমে টাকা দিয়ে ভালো কাজের প্রলোভন দেখিয়ে মালয়েশিয়ায় পাঠানো হয়।
গেল ৩-৬ মাসেও দালাল চক্রের সদস্যরা কোন কাজ দিতে পারেনি। দালাল চক্রের পক্ষ থেকে প্রথমে খাবার ও পানি দেওয়া হলেও এখন তা বন্ধ করে দিয়ে টাকা দাবি করা হচ্ছে। দেওয়া হচ্ছে বিভিন্নভাবে প্রাণনাশের হুমকি।
মালয়েশিয়াতে আটকে থাকা একাধিক ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা জানান, সন্তান ও পরিবারের সদস্যদের স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে কেউ দিয়েছেন জমি বন্ধক রেখে, কেউ সুদের উপরে টাকা নিয়ে, কেউ বা তুলেছেন ঋণের কিস্তি। এখন যাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছি তারা বাড়ির উপর এসে টাকা নেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে।
কাজিপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ফারুক আহমেদ জানান, আমার এলাকার অনেক যুবক দালাল চক্করের খপ্পরে পড়ে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমিয়েছেন। ওরা অনেক খরচ করে গিয়েছেন। তিন মাস যাবত কাজ না পেয়ে মানবতার জীবনযাপন করছেন। আমরা তার পরিবারের পাশে সব সময় আছি।
দালাল চক্রের সদস্য সাহেবনগর গ্রামের বাবলু জানান, আমি চার জনের কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা করে নিয়ে মুছা এন্টারপ্রাইজের মাধ্যমে মালেশিয়া পাঠিয়েছি। ৩/৪ মাস পাঠানো হলেও আমার লোকজনকে কোনো কাজ দেইনি এজেন্সি মুসা এন্টার প্রাইজ। আজকে আমি তাদের খাবারের জন্য পাঁচ হাজার করে টাকা পাঠিয়েছি।
মানব পাচারকারী আলোচিত দালাল গাংনী উপজেলার সাহেব নগর গ্রামের সুরুজ আলীর মোবাইলে কল করা হলে মোবাইল বন্ধ পাওয়ায় বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। মানব পাচারকারী এজেন্সি মুছা এন্টারপ্রাইজের সত্বাধিকারী আবু মুছার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
গাংনী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রীতম সাহা বলেন, ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা থানায় অথবা আমার নিকট অভিযোগ করলে দালালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মেহেরপুর পুলিশ সুপার এস এম নাজমুল হক বলেন, আমরা প্রাইমারি ইনভেস্টিগেশন শুরু করেছি। এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মেহেরপুর জেলা প্রশাসক শামীম হাসান বলেন, বিষয়টি আমার নজরে এসেছে। ভুক্তভোগী সকলের পরিবারকে থানায় মামলা করতে বলা হয়েছে। এবিষয়ে কোন মামব পাচারকারীকে ছাড় দেয়া হবেনা।