উচ্চশিক্ষা ও সুন্দর ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরা হোঁচট খাচ্ছেন শুরুতেই। ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতেই ‘র্যাগিং’ নামক ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাদের। হলে তৈরি করা বিশেষ টর্চার সেল, শ্রেণিকক্ষ, থাকার হল, খাওয়ার ক্যান্টিন এবং কখনো কখনো পাঠকক্ষেও হয়রানির শিকার হচ্ছেন তারা।
শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার-এমন শিক্ষার্থীদের অনেকেই হল ছেড়ে মেসে উঠেছেন। কেউ আবার বাধ্য হয়েছেন ক্যাম্পাস ছাড়তে। নির্যাতনে বিকলাঙ্গ হওয়া এবং প্রাণ হারানোর ঘটনাও ঘটেছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র্যাগিং নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এবং প্রশাসনের উদাসীনতায় যুগের পর যুগ চলছে এই অপসংস্কৃতি। ‘ম্যানার’ শেখানো ও ‘গ্রুপ মিটিং’-এর নামে সিনিয়র শিক্ষার্থীরা জুনিয়রদের সঙ্গে এমন অশোভন আচরণ করছেন।
সময়ের পরিক্রমায় নির্যাতিত শিক্ষার্থীও হয়ে উঠছেন নিপীড়ক। এতে র্যাগিং আতঙ্কে শিক্ষার্থীদের কোমল মনে যে দাগ কাটছে, এর প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায়।
গত ৫ বছরে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তিন শতাধিক র্যাগিংয়ের খবর গণমাধ্যমে এসেছে। এসব ঘটনায় পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
করোনার প্রাদুর্ভাবের ফলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ হয়ে যায় সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ফলে র্যাগিংও অনেকটা বন্ধ থাকে। কিন্তু চলতি বছরের ১২ সেপ্টেম্বর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললে ফের শুরু হয় র্যাগিং।
গত এক মাসে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তত ২৭টি র্যাগিংয়ের ঘটনা সামনে আসে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিংয়ের শাস্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠান থেকে স্থায়ী বহিষ্কারের নির্দেশনা থাকলেও তা তোয়াক্কা না করেই চলছে শিক্ষার্থী নির্যাতন।
আগে ছাত্রী হলগুলোয় তুলনামূলকভাবে র্যাগিং কম হলেও এখন তা বাড়ছে। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে প্রথম বর্ষের এক ছাত্রীকে ডেকে নিয়ে গান বাজিয়ে আড়াই ঘণ্টা নাচতে বাধ্য করেন সিনিয়র ছাত্রীরা।
করোনা পরিস্থিতির আগে দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ২০১৮ সালের কার্যক্রমের ওপর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) এক প্রতিবেদনে শারীরিক নির্যাতন ও র্যাগিং বন্ধের সুপারিশ করা হয়।
৪০টি সরকারি ও ৯৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তৈরি ওই প্রতিবেদন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে হস্তান্তর করে ইউজিসি। এতেও মেলেনি প্রত্যাশিত সুফল। কোনো প্রতিষ্ঠানে বড় ধরনের র্যাগিংয়ের ঘটনার পর প্রশাসন কঠোর অবস্থানে গেলে কিছুদিন তা বন্ধ থাকছে।
এরপর পরিস্থিতি আগের অবস্থায়ই ফিরে যায়। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এখন ভর্তিপ্রক্রিয়া চলছে। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই ক্যাম্পাসে প্রবেশ করবে নতুন ব্যাচের শিক্ষার্থীরা। তাদের যাতে নতুন করে র্যাগিংয়ের মুখোমুখি হতে না হয়, সেজন্য এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে কথা হয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ইমেরিটাস অধ্যাপক একে আজাদ চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, র্যাগিং এক ধরনের ন্যক্কারজনক ও জঘন্য কাজ।
শিক্ষাঙ্গনের র্যাগিংয়ের এ অবস্থায় ছাত্রদের হিংস্র মানসিকতার কিছু বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। তাতে আমরা হতাশ হচ্ছি। এটাকে শক্তভাবে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করে বন্ধ করতে হবে। বুয়েটের একটা ছেলের জীবন গেল, আরও কত জায়গায় জীবন আশঙ্কার মধ্যে পড়েছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণ অত্যন্ত বেশি প্রয়োজন।
শিক্ষাঙ্গনে উচ্চমানসিকতার চর্চা যেখানে করবে, মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটাবে, সেখানে এই অধঃপতন গ্রহণ করা যায় না। আমরা চাই, ছাত্রছাত্রী, অভিভাবক ও সমাজ এই অবস্থা থেকে উত্তরণে সাহায্য করবে। মূল্যবোধহীন শিক্ষা নিয়ে তো কোনো লাভ হবে না।
ক্যাম্পাসগুলোয় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাধারণত আচরণ শেখানো ও পরস্পরের পরিচিতির জন্য শিক্ষার্থীদের একত্র করে ‘গেস্টরুম’-এ ডাকা হয়। সেখানে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ঘটনা অনেকটা নিয়মিত। শয়নকক্ষ, আহারকক্ষ, অতিথিকক্ষ, গণরুম ও খোলা জায়গায় শিক্ষার্থীদের জড়ো করে করা হয় নির্যাতন।
অনেক সময়ে ডেকে নেওয়া হয় আলাদাভাবে। কেউ ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের কর্মসূচিতে যেতে না পারলে, বাড়ি যেতে চাইলে ‘গেস্টরুমের বড় ভাইদের’ কাছ থেকে ছুটি নিতে হয়। সাধারণত রাতেই এসব রুমে ডাকা হয়ে থাকে।
সেখান থেকে দেওয়া নির্দেশের কারণে শিক্ষার্থীদের অনেক সময় রাতে না ঘুমিয়ে ক্যাম্পাসে ঘুরতে হয়। অনেকে আবার এভাবে দলবেঁধে ঘুরে জড়িয়ে পড়েন নানা অপকর্মে। অনেক সময় ছাত্র সংগঠনের মদদ ছাড়াও অতি উৎসাহী হয়ে সিনিয়ররা জুনিয়রদের হয়রানি করে থাকেন।
শিক্ষার্থীরা জানান, সিট দখলের মাধ্যমে হলে আধিপত্য বিস্তারকে ঘিরেই মূলত বেশির ভাগ ক্যাম্পাসে গড়ে উঠেছে নিপীড়নের সংস্কৃতি। মফস্বল থেকে আসা শিক্ষার্থীরা হলে একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই পেতে ছাত্রলীগের নির্দেশনা মানতে বাধ্য হচ্ছেন। প্রশাসনিকভাবে সিট দেওয়া শুরু হলে এ সংকট অনেকাংশেই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব বলে মনে করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
দেশের প্রথম সারির ১০টি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের র্যাগিংয়ের ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, যেসব ক্যাম্পাসে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের কমিটি নেই অথবা মেয়াদোত্তীর্ণ, তুলনামূলকভাবে সেখানে র্যাগিংয়ের ঘটনা কম।
আবার যেখানে কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, সেখানেও ‘ক্লিন ইমেজ’ ধরে রাখার স্বার্থে পদপ্রত্যাশীরা জুনিয়রদের নির্যাতন না করার বিষয়ে কড়া নির্দেশনা দিয়েছেন।
নির্যাতনের পরিবর্তে তাদের অনেকে পাঠচক্র, আলোচনা চক্রের মতো ব্যতিক্রমী আয়োজনও করছেন। আবার বুয়েটের মতো ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ-এমন প্রতিষ্ঠানগুলোয় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে শিক্ষার্থী নির্যাতন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় যুগান্তরকে বলেন, গেস্টরুম কালচার আজকের নয়। এটা দীর্ঘদিন ধরে চলে এসেছে। আমরাও প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়ে গেস্টরুম করেছি। ‘গেস্টরুম’-এর মধ্যে শিক্ষার্থীদের সব সময় হেয় করা হয়-বিষয়টি এমন নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হিসাবে আমি দেখেছি ‘গেস্টরুম’ বলতে সাধারণত যে বিষয়টি আমরা বুঝি তা ভিন্নভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করছে একটি পক্ষ। কারণ, এই গেস্টরুমের মাধ্যমেই আমাদের সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। একে অপরকে চিনতে পেরেছি।
একটি হলে প্রায় দেড় হাজার শিক্ষার্থী থাকে। একজন নতুন শিক্ষার্থী যখন আসে, তখন কে সিনিয়র, সেটি তারা বুঝতে পারে না। গেস্টরুমের মাধ্যমেই সেই পরিচয়টি হয়। কথা হলো, গেস্টরুমের মধ্যে কেউ খারাপ কিছু করল কি না।
গেস্টরুমে নেতিবাচক কোনো কাজকে ছাত্রলীগ সমর্থন করে না। ছাত্রলীগের নামে গেস্টরুমে যে দু-একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে, তাদেরও আমরা ছাড় দিইনি। বরং গেস্টরুমে পাঠচক্র, আলোচনাচক্রের মতো ইতিবাচক সংস্কৃতিও আমরা নিয়ে এসেছি।
ঢাবিতে চলছে গেস্টরুম : খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি হলে ‘গেস্টরুমের’ পৃথক চিত্র রয়েছে। সম্প্রতি কোনো কোনো হলে শিক্ষার্থীরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
এসব ঘটনায় তীব্র সমালোচনার মুখে কেন্দ্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে হয়রানি বন্ধে কড়া নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ফলে বেশির ভাগ হলেই এখন শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা অনুপস্থিত।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অন্তত চারটি হলের বেশ কয়েকটি গ্রুপের গেস্টরুম বন্ধ রয়েছে। তবে অনেক হলে রয়েছে ভিন্ন চিত্রও। সেখানে নবীনদের পরিচিতি সভা ও পাঠচক্র-আলোচনাচক্রের আয়োজন যুক্ত হয়েছে গেস্টরুমগুলোয়।
স্বস্তি ফিরেছে বুয়েটে : বদলে গেছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) চিত্র। আলোচিত আবরার হত্যার পর ক্যাম্পাসটির আবাসিক হলের র্যাগিং সংস্কৃতি নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বুয়েটে নিষিদ্ধ হয় ছাত্ররাজনীতি।
হলগুলোয় বেড়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নজরদারি। ফলে প্রতিষ্ঠানটিতে র্যাগিং কালচার এখন শূন্যের কোঠায়। ২০১৯ সালের অক্টোবরে আবরার হত্যার আগে জুনিয়র শিক্ষার্থীরা সিনিয়রদের সালাম না দিলেও শুরু হতো শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।
আর এই নির্যাতনের মধ্যে ছিল-অকথ্য ভাষায় গালি দেওয়া, এক পায়ে দাঁড় করানো, কান ধরে দাঁড় করানো, চেয়ার ছাড়া চেয়ারে বসার ভান করে থাকা, মাটিতে বসে দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে কান ধরে মুরগি হওয়াসহ নানা ধরনের নির্যাতন।
শুধু তাই নয়, কারও ওপর বেশি ক্ষোভ থাকলে তাকে পায়ের নিচ দিয়ে কান ধরে স্টাম্পের ওপর বসানো হতো। একাধিক সিনিয়রের কারও বিষয়ে অভিযোগ থাকলে তাকে স্টাম্প, প্লাস্টিকের পাইপ দিয়ে বেধড়ক প্রহার করা হতো।
কীভাবে র্যাগিং সংস্কৃতি বন্ধ করা হয়েছে জানতে চাইলে বুয়েটের ছাত্রকল্যাণ পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, আবরারের ঘটনার পর বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে দুই বছরের মতো একাডেমিক বহিষ্কার এবং আবাসিক হল থেকে আজীবন বহিষ্কার করেছি।
এই শাস্তি দেখে অনেকেই র্যাগিং থেকে সরে এসেছে। এছাড়াও আমাদের আবাসিক হলের প্রাধ্যক্ষরা নিয়মিত তদারকি করছেন। ফলে এখন র্যাগিংয়ের কোনো সুযোগ নেই।
জাবিতে হলে উঠলে র্যাগিং : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) আগের মতো নেই র্যাগিংয়ের ভয়াবহতা। তবে এখনো নবীন শিক্ষার্থীরা হলে ওঠার পর সুযোগ পেলেই র্যাগিংয়ের ঘটনা ঘটে। প্রথম বর্ষের নবীন শিক্ষার্থীদের হলে ওঠার পর তিন থেকে পাঁচ মাস র্যাগিংয়ের ঘটনা বেশি ঘটে।
র্যাগিংয়ের প্রভাবে অনেক শিক্ষার্থী ছাত্রত্ব বাতিল করে অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে যাওয়ার নজিরও রয়েছে। ২০১৯ সালে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এক শিক্ষার্থী র্যাগিংয়ের শিকার হয়ে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন।
একই বছর সরকার ও রাজানীতি বিভাগের রাজন মিয়াকে থাপ্পড় মেরে কানের পর্দা ফাটিয়ে দেয় মীর মশাররফ হোসেন হলের দ্বিতীয় বর্ষের দুই শিক্ষার্থী। ছেলেদের হলের তুলনায় কম হলেও মেয়েদের হলেও ঘটছে র্যাগিংয়ের ঘটনা।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রক্টর (ভারপ্রাপ্ত) আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা র্যাগিংয়ের বিষয়ে সত্যিকার অর্থে জিরো টলারেন্স ভূমিকায়। আমরা চাই, এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে র্যাগিং চিরতরে বন্ধ হোক। সেই লক্ষ্যে আমরা নিরলস কাজ করে যাচ্ছি।’
রাবিতে থামছে না নির্যাতন : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো (রাবি) ম্যানার শেখার নামে সিনিয়র ভাইদের দ্বারা মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের যুগান্তরের প্রতিনিধি জানান, একাডেমিক ভবনের ছাদে, আবাসিক হলের ছাদে এবং কখনো ক্যাম্পাসের বিভিন্ন চত্বরে এ নির্যাতন করা হয়।
নির্যাতনের মাত্রা সহ্য করতে না পেরে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। তবে এ নির্যাতনে জড়িতদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না।
সর্বশেষ ৫ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের ২০১৯-২০ সেশনের সামি এম সাজিদ নামের এক শিক্ষার্থীকে হলের ছাদে নির্মম নির্যাতন করা হয়। লাথি, কিল ঘুসি, বেধড়ক লাঠিপেটায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেলে ভর্তি করা হয়।
২০১৮ সালে এমন নির্যাতনের শিকার এক শিক্ষার্থী ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে নিজ বাড়িতে চলে যান। তিনি আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরেননি।
র্যাগিং কমেছে জবিতে : যুগান্তরের জবি প্রতিনিধি জানান, প্রতিবছর প্রথম বর্ষের নবীন শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে এলে তাদের র?্যাগিংনামক ভয়ানক এক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘদিন ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় এর মাত্রা অনেকটা কম।
র্যাগিং কমার আরেকটি কারণ হলো ৩ বছর ধরে ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগের কমিটি না থাকা। এসবের পাশাপাশি রয়েছে প্রশাসনের তৎপরতা। গত বছর এক বিজ্ঞপ্তিতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, র্যাগিংয়ের সঙ্গে কেউ জড়িত থাকলে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হবে।
ইবিতে ভর্তির পরই শুরু হয় র্যাগিং : ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) শ্রেণিকক্ষ ও আবাসিক হলগুলোয়ও সিনিয়র কর্তৃক জুনিয়ররা র্যাগিংয়ের শিকার হচ্ছেন। ভর্তির দিন থেকে শুরু করে ক্লাস শুরুর কয়েক মাস এ অবস্থা চলমান থাকে।
শ্রেণিকক্ষগুলোয় ইমিডিয়েট সিনিয়ররা পরিচিত হওয়ার নামে গ্রুপভিত্তিক র্যাগিং করে থাকেন। আলোচিত কয়েকটি র্যাগিংয়ের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ১০ শিক্ষার্থী বহিষ্কার হয়েছেন। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির ভিসি প্রফেসর ড. শেখ আবদুস সালাম যুগান্তরকে বলেন, ‘র্যাগিং মানসিক নির্যাতন।
এর মাধ্যমে নতুন শিক্ষার্থীদের মনে ভীতির সৃষ্টি হয়। ফলে তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব ঘটনায় প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তিও নষ্ট হয়। একইভাবে যাদের থেকে শিক্ষার্থীরা সদাচার শিখবে, তাদের প্রতি ঘৃণা জন্মে। ঘৃণ্য ও ভয়ের সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে ভালো কিছুর সৃষ্টি হয় না। জোর করে সম্মান আদায় করা যায় না, সম্মান আসে শ্রদ্ধাবোধ থেকে।’
বাকৃবিতে গেস্টরুম আতঙ্কে হল ছাড়েন অনেকে : বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) ছেলেদের আবাসিক হলে রয়েছে গেস্টরুম সংস্কৃতি। ১ম বর্ষের ছাত্রদের ক্লাস শেষে বিকালে আবাসিক হলে শোডাউনে অংশ নিতে হয়।
এরপর সন্ধ্যায় হলের অতিথি কক্ষে গভীর রাত পর্যন্ত দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। শেখানো হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চলাফেরার ‘আদব বা নৈতিকতা’। চলে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। র্যাগিংয়ের ভয়ে অনেক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের মেসে ওঠেন।
ছাত্রলীগের নতুন কমিটি দেওয়ার আগে ও নতুন কমিটি চলাকালে প্রতিদিনই চলে গেস্টরুম কালচার। এ বিষয়ে প্রক্টর অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মহির উদ্দীন বলেন, গেস্টরুম বন্ধে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, প্রতিনিয়ত হলগুলো পরিদর্শন করছি। শিক্ষার্থীরা যাতে র্যাগিংমুক্ত ক্যাম্পাসে পড়ালেখার সুন্দর পরিবেশ পায়, সে লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি।
শাবিতে নিয়ন্ত্রণে র্যাগিং : সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিং বন্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি, এর দায়ে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি, অর্থদণ্ড এবং বিভিন্ন সময়ে জনসচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডে এ সংস্কৃতি এখন অনেকটাই কমেছে।
তবে এখনো বিভিন্ন সময়ে আবাসিক হল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের এলাকার মেসগুলোয় শিক্ষার্থীদের র্যাগিংয়ের ঘটনা ঘটছে। দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা পরিচয় পর্বে রোবটিক স্টাইলে পরিচয় দেওয়া, প্রত্যেক সিনিয়রকে আলাদা করে সালাম দেওয়া, বিভিন্ন স্টাইলে ড্যান্স করানোসহ ব্যক্তিগত বিভিন্ন প্রশ্ন করে নাজেহাল করছে।
এছাড়া অর্ধনগ্ন করে ছবি তুলতে বাধ্য করা, এক পায়ে দীর্ঘক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখা, ১০০ বার সালাম দেওয়ানো, কান ধরে ওঠবস করানো, দিয়াশলাইয়ের কাঠি বা এক টাকার পয়সা দিয়ে রুমের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ পরিমাপ করানোর মতো নির্মমতাও চলত এসব হলে বা মেসে।
শেকৃবিতে ‘গেস্টরুম’-এর নামে চলে নির্যাতন : করোনা পরবর্তীতে ক্যাম্পাস খুলতেই ম্যানার শেখানোর নামে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শেকৃবি) শুরু হয়েছে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। বিভিন্ন অঞ্চলের রাজনৈতিক নেতাদের নির্দেশনায় ইমিডিয়েট সিনিয়র ছাত্রদের দ্বারা নতুন ছাত্ররা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
গত অক্টোবরে নবাব সিরাজউদ্দৌলা হলের দশ তলায় কুমিল্লা অঞ্চলের ‘মিটিং’য়ের সময় প্রক্টরিয়াল বডির অভিযান করে। তবুও তারা থেমে নেই। নভেম্বর মাসেই কয়েক দফায় উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গের বেশ কিছু জুনিয়র ছাত্রকে মিটিংয়ের নামে নির্যাতন করার অভিযোগ উঠেছে।
এসব মিটিংয়ে বিভিন্ন ভুল ধরার নামে শিক্ষার্থীদের চড়-থাপ্পড় মারা হয়। নির্যাতন রাত ৩ থেকে ৪টা পর্যন্ত চলে। নির্যাতনের ফলে কৃষকরত্ন শেখ হাসিনা হল ও শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের কয়েকজন ছাত্রী অসুস্থ হন।
এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শহীদুর রশীদ ভূঁইয়া বলেন, এ নিয়ে আমরা খুবই কঠোর অবস্থানে আছি। শিগগিরই হলে হলে নোটিশ দেওয়া হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ধরে রাখতে যা পদক্ষেপ নেওয়া দরকার তাই করব।