শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ঘড়িসার ইউনিয়নের কলারগাঁও গ্রামের সুশান্ত কর্মকার (৩৪)। পা ফোলা ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে গত মঙ্গলবার দুপুরে ভর্তি হন শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকির আশঙ্কায় তাঁকে আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। পরে বুধবার বিকেল পৌনে চারটার দিকে তাঁর মৃত্যু হয়।
মৃত্যুর পর স্বজন ও গ্রামবাসী কেউ লাশ দেখতে আসেননি। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করার জন্যও এগিয়ে আসেননি কেউ। ছেলের লাশের পাশে মা গঙ্গা রানী কর্মকার আহাজারি আর আর্তনাদ করে যাচ্ছিলেন। ফোনে স্বজন, অন্য সন্তান আর গ্রামবাসীকে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করছিলেন। কিন্তু কেউ তাঁর আর্তনাদে সাড়া দেননি। এমনকি সুশান্তর বড় ভাই, চার বোন ও বোনের পরিবারের সদস্যরাও ফিরে তাকাননি।
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করা নিয়ে বিপাকে পড়েন সুশান্তের মা রানী কর্মকার ও স্থানীয় প্রশাসন। তখন শরীয়তপুর জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক রাজন পাল উদ্যোগ নেন।
তিনি ওই গ্রামবাসী ও ডিঙ্গামানিক শ্রীশ্রী সত্য নারায়ণের সেবা মন্দিরের কমিটির সদস্যদের নিয়ে সভা করেন। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় মন্দিরের শ্মশানে ওই যুবককে দাহ করা হবে। কিন্তু দাহ করার কাজে যুক্ত হতে কেউ রাজি হচ্ছিলেন না।
তখন রাজন পালের সঙ্গে যোগ দেন জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সহসভাপতি ত্রিনাথ ঘোষ, যুগ্ম সাধারণ সস্পাদক মিহির চক্রবর্তী, সদস্য দিলীপ ঘোষ, নড়িয়া উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি চন্দন ব্যানার্জি।
তাঁরা গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে ওই গ্রামবাসী ও যুবকের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেন। কিন্তু লাশের কাছে কেউ আসতে রাজি হচ্ছিলেন না। এমন পরিস্থিতিতে উপজেলা প্রশাসন পড়ে বিপাকে। তখন লাশ দাহ না করে বিকল্প ভাবতে থাকে প্রশাসন।
পূজা উদযাপন পরিষদের নেতারা বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ভেদরগঞ্জ উপজেলার দুই যুবক ও নড়িয়া উপজেলার তিন যুবক দাহকাজ করতে রাজি হন।
পরে তাঁদের সহযোগিতায় ছেলে মারা যাওয়ার ২১ ঘণ্টা পর বেলা পৌনে একটার দিকে নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্সে করে লাশ নিয়ে ডিঙ্গামানিকে শ্রীশ্রী সত্য নারায়ণের সেবা মন্দিরে রওনা হন বৃদ্ধ গঙ্গা রানী কর্মকার। যাওয়ার সময় হাসপাতাল চত্বরে আহাজারি করে তিনি বলেন, ‘জীবনের শেষ বয়সে ছেলের লাশের ভার আমাকে এভাবে বইতে হবে, তা ভাবতে পারিনি।
এভাবে মানুষের মানবতা হারিয়ে গেল? কী হবে এ পৃথিবীতে বেঁচে থেকে? কিসের জন্য বেঁচে থাকা? মানুষের কল্যাণের জন্যই যদি কাজ না করতে পারি। কেউ আমার আর্তনাদ শুনল না। সন্তান, স্বজন, গ্রামবাসী কেউ না। আমার মতো এমন পরিণতি কাউকে যেন দেখতে না হয়।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জয়ন্তী রুপা রায় বলেন, ‘করোনায় মৃত অথবা করোনা সন্দেহ আছে, এমন মৃতদেহ বিশেষ সুরক্ষা মেনে সৎকার করতে হয়। আমরা সে অনুযায়ী পিপিই সরবরাহ করেছি। কিন্তু কাউকেই রাজি করাতে পারছিলাম না। যাকেই রাজি করাই, তিনিই পালিয়ে যান। পরবর্তী সময়ে অন্য উপজেলার ও নড়িয়ার অন্য ইউনিয়নের যুবকেরা এগিয়ে আসেন।’
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সত্য নারায়ণের সেবা মন্দিরে ওই যুবকের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া কাজ শেষ করা হয়। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া কাজ সম্পন্ন করেছেন ভেদরগঞ্জ উপজেলার রামভদ্রপুর গ্রামের পরিমল বাড়ৈ, রণজিৎ মণ্ডল, নড়িয়ার বাড়ৈপারা গ্রামের উত্তম পাল, ঘড়িসার গ্রামের অনুকূল ঘোষ ও চাকধ গ্রামের সঞ্জয় বণিক।
এদিকে সুশান্তকে হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি করার পর মঙ্গলবার দুপুরেই করোনা পরীক্ষার জন্য তাঁর নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকার রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) পাঠানো হয়। পরে প্রতিবেদনে দেখা যায় ওই যুবকের করোনা শনাক্ত হয়নি। এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের চিকিৎসক আবদুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘মঙ্গলবার ওই যুবকের নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআরে পাঠানো হয়। বুধবার করোনা প্রতিবেদনে তাঁর নেগেটিভ ফল আসে।’
মারা যাওয়া সুশান্ত কর্মকার স্থানীয় ঘড়িসার বাজারের একটি স্বর্ণের গয়না প্রস্তুত কারখানায় কাজ করতেন। তাঁর আরেক ভাই ও চার বোন আছে। বেশ কয়েক বছর আগে বাবা মারা গেছেন। বড় ভাই তাঁর স্ত্রী–সন্তান নিয়ে আলাদা থাকেন।
চার বোনই বিয়ের পর তাঁদের স্বামীদের সঙ্গে থাকেন। মা গঙ্গা রানীকে নিয়ে সুশান্ত কলারগাঁও গ্রামে পৈতৃক ভিটায় থাকতেন। বেশ কিছু দিন ধরে শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন তিনি। সঙ্গে ছিল পা ফুলে যাওয়ার সমস্যা।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে গত মঙ্গলবার দুপুরে তাঁর মা নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। সেখান থেকে তাঁকে পাঠানো হয় শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে। শ্বাসকষ্ট থাকায় করোনা সন্দেহে সুশান্তকে আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছিল।
ডিঙ্গামানিক সত্য নারায়ণের সেবা মন্দিরের সাধারণ সম্পাদক মুকুল চন্দ্র রায় বলেন, ‘ওই যুবকের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া কাজে কেউ রাজি হচ্ছিল না। কোনো শ্মশানেও নিতে চাচ্ছিল না। তখন আমরা রাজি হই। এভাবে অবহেলা করা ঠিক হয়নি।’
শরীয়তপুর জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মানিক ব্যানার্জি বলেন, ‘যখন শুনতে পাই হিন্দু সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তির মরদেহ হাসপাতালে পড়ে আছে, কেউ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় সহায়তা করছে না, তখন মনটা খারাপ হয়ে যায়। ঢাকায় অবস্থান করার কারণে আমি যেতে পারিনি। কিন্তু আমাদের স্থানীয় নেতাদের মাঠে নামিয়ে দিই। যেকোনো উপায়ে যথাযথ ধর্মীয় নিয়মে ওই যুবকের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মারা যাওয়ার ২১ ঘণ্টা পর তাঁর লাশ হাসপাতাল থেকে এনে দাহ কাজ শুরু করা হয়। এ কাজটি না করতে পারলে সমাজে মুখ দেখাতে পারতাম না।’
জেলা প্রশাসক কাজী আবু তাহের বলেন, ‘করোনা সন্দেহ করে কেউ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া কাজে এগিয়ে আসতে চাচ্ছিল না। বিষয়টি নিয়ে কিছুটা উদ্বেগের মধ্যে ছিলাম। পরবর্তী সময়ে পূজা উদ্যাপন পরিষদের নেতাদের উদ্যোগে তা সম্পন্ন করা হয়েছে। প্রতিটি উপজেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের নিয়ে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করার কমিটি গঠন করা নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
সূত্র- প্রথম আলো