ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে লেজুড়বৃত্তি ছাত্র ছাত্ররাজনীতি বন্ধের কথা বলেছেন সাবেক ছাত্রনেতারা। তারা ছাত্র সংগঠন গুলোকে স্বাধীন রাখার পক্ষে মত দেন এবং নির্বাচিত ছাত্র সংসদ প্রতিষ্ঠার কথা বলেন। সাবেক ছাত্রনেতারা বলেন, ছাত্ররাজনীতি ছাড়া জাতীয় রাজনীতি হয় না।
গতকাল সোমবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের আয়োজনে ‘বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতি ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা’ শীর্ষক এক গোল টেবিল বৈঠকে বক্তারা ছাত্ররাজনীতি নিয়ে কথা বলেন।
সাবেক ছাত্রনেতা ও বর্তমানে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেছেন, ছাত্র রাজনীতিকে জাতীয় রাজনীতি থেকে বিযুক্ত করার কোনো বিষয় নেই।
জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে ছাত্ররাজনীতিকে যুক্ত করতে হবে। তবে তা ওপর থেকে নিচে নয়, নিচ থেকে ওপরে হতে হবে। এখন ওপর থেকে নিচে হচ্ছে বলে ছাত্ররাজনীতির মূল বিষয়গুলো হারিয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ‘আমার বোধের মধ্যে আসে না কীভাবে ছাত্র সংগঠনের গঠনতন্ত্রের মধ্যে দলের প্রধানেরা সাংগঠনিক প্রধান হয়ে যান। এই হস্তক্ষেপের বিষয়গুলো এগুলোর বিরুদ্ধে আমরা একসময় কথা বলেছি। ছাত্ররাজনীতিতে রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করে স্বাধীন সংগঠনে পরিণত করতে হবে। তাহলে আমরা এগোতে পারব।’
ছাত্র সংগঠনগুলোকে সঠিক জায়গায় দাঁড় করাতে হলে ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে বাধ্যতামূলক করার কথা বলেন রাশেদ খান মেনন। তিনি বলেন, ছাত্ররাজনীতিকে যদি কলুষমুক্ত করতে হয় তাহলে জাতীয় রাজনীতিকে কলুষমুক্ত করেই তা করতে হবে।
রুগ্ন ছাত্ররাজনীতি ও জাতীয় রাজনীতির কারণেই বর্তমান সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে উল্লেখ করে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, লুটপাটের অর্থনীতি বজায় থাকলে সুস্থধারার ছাত্ররাজনীতি ও জাতীয় রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত করা যাবে না। ছাত্ররাজনীতিতে শুধু ছাত্রদের বিষয় নিয়ে থাকলেই হবে না, দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়েও সচেতন থাকতে হবে।
সিপিবি সভাপতিও প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত ছাত্র সংসদ চালানোর কথা বলেন। তিনি ডাকসুর প্রাক্তন ভিপি, জিএস নিয়ে ‘কাউন্সিল অব এক্স ভিপিস জিএস অব ডাকসু’ প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব দেন।
জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, জাতীয় রাজনীতি সঠিকভাবে না থাকলে ছাত্ররাজনীতিও থাকবে না।
দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করতে হলে ছাত্ররাজনীতি থাকতে হবে।
ডাকসুর সাবেক ভিপি ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, সত্যের পক্ষে তারুণ্যের থাকতে হবে। এই দেশে এখন পর্যন্ত গণতন্ত্রের আন্দোলনের ভ্যানগার্ড হচ্ছে ছাত্ররা। ন্যায়ের সংগ্রামে ছাত্রদের আরও বেশি করে যুক্ত হতে হবে।
জাতীয় রাজনীতিতে ছাত্রদের এখন বেশি করে যুক্ত করা দরকার।
ডাকসুর নির্বাচন হওয়ার পরে এ সময়ের মধ্যে ডাকসু নেতারা শিক্ষার্থীদের জন্য কী ধরনের কাজ করতে পেরেছে বা সরকারের কাছে কী দাবি উত্থাপন করেছে তা নিয়ে প্রশ্ন রাখেন আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য রিয়াজুল কবির কাওসার।
এ ছাড়া তিনি বলেন, শিক্ষক রাজনীতি বা ছাত্ররাজনীতিতে কিছু সমস্যা থাকলেও শিক্ষা ব্যবস্থা ধসে যায়নি। শিক্ষা ব্যবস্থা আগের চেয়ে অনেক এগিয়েছে। তবে তিনিও ডাকসুর মতো দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব থাকা প্রয়োজন বলে জানান।
ডাকসুর সাবেক ভিপি ও বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান বলেন, এখন ঐতিহাসিক পরিবর্তন প্রয়োজন। সেই পরিবর্তনের জন্য তিনি ভিপি নুরুল হককে নেতৃত্ব দেওয়ার আহ্বান জানান।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাজনীতিতে না জড়ালে দেশ কীভাবে এগোবে প্রশ্ন রেখে ডাকসুর ভিপি নুরুল হক বলেন, রাজনীতির নামে যে অপরাজনীতি চলে তার দায় গুটিকয়েক ছাত্রসংগঠনের। তার মধ্যে আছে ছাত্রদল, ছাত্রলীগ ও ছাত্র শিবির।
ছাত্র সংগঠনের কমিটি হয়, দলের প্রধানদের নিয়ন্ত্রণে উল্লেখ করে নুরুল হক বলেন, ছাত্রদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া হয় না। যোগ্যদের নেতৃত্বে আনা হয় না। এ ছাড়া বলেন, জাতীয় রাজনীতিবিদরা যখন এক জায়গায় আসতে পারেননি তখন ছাত্ররা তাদের এক করতে বাধ্য করেছে। দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি যারা করছেন তাদের বাইরে যারা আছেন তারা এক হতে পারলে বিপ্লবের জন্য যথেষ্ট বলে জানান।
গোল টেবিলে সভাপতির বক্তব্যে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, শিক্ষার গুণগত মান, কর্মক্ষেত্রে যোগ্য লোক না পাওয়ার বিষয়গুলো ছাত্ররাজনীতির পাশাপাশি আলোচনায় আসা দরকার।
সঞ্চালকের ভূমিকায় সুজনের সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘ছাত্ররাজনীতির অনেক ঐতিহ্য আছে।
আমরা ছাত্ররাজনীতি বন্ধের পক্ষে নই। তবে লেজুড়বৃত্তি ছাত্ররাজনীতির বিপক্ষে।’
সুজনের পক্ষ থেকে ছাত্ররাজনীতিতে সুস্থতা ফিরিয়ে আনার জন্য কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী লেজুড়বৃত্তি ছাত্ররাজনীতি ও শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেধা-যোগ্যতার ভিত্তিতে সিট বরাদ্দ, রাজনৈতিক বিবেচনায় উপাচার্য, শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ করা, ছাত্র সংগঠনের সহাবস্থান নিশ্চিত করা, নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন করা, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা।
গোলটেবিলে আরও বক্তব্য দেন গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি আবু সাইয়িদ, সিপিবির কেন্দ্রীয় নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স, সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত ও আবু সাঈদ খান, শিক্ষাবার্তা সম্পাদক এ এন রাশেদা প্রমুখ।
-নিজস্ব প্রতিনিধি