একটা সময় ছিলেন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চরমপন্থী সংগঠন পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে পর্যদুস্ত হয়ে আত্মসমর্পণ করেন। জড়িয়ে পড়েন চোরা কারবারে। আর আলাদিনের চেরাগ পেয়ে যান আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এসে। বনে যান আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ। এখন তিনি কয়েক শত কোটি টাকার সম্পদের অধিকারী। এলাকাবাসীর মতে নামে ও বেনামে এসব সম্পদ করেছেন তিনি।
গল্পটি মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার যতারপুর গ্রামের স্বাধীনতা বিরোধী ও তালিকাভুক্ত রাজাকার আমিনুল ইসলামের পুত্র আমাম হোসেন মিলুর। তিনি মুজিবনগর উপজেলার অপসারিত চেয়ারম্যান। এর আগে তিনি মহাজনপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন।
গণঅভ্যুত্থানের পরও বিগত ১৬ বছরে প্রদর্শন করা দৌর্দাণ্ড দাপটের বিন্দুমাত্র কমেনি তার পরিবারের সদস্যদের।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতন পরবর্তী সময়ে একাধিক মামলার এজহারভূক্ত আসামি হলেও মিলুকে আটক করতে তার বাড়িতে এখন পর্যন্ত পুলিশ বা যৌথ বাহিনীর কোন সদস্য পদার্পণ করেনি। স্থানীয়দের অভিযোগ মিলুর আত্মীয়দের মধ্যে জেলা বিএনপি’র কয়েকজন প্রভাবশালী নেতাকর্মী থাকাতে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরেও তার ক্ষমতার কোনো ঘাটতি ঘটেনি। মিলুর ছোট ভাই শিলুর বেয়াই রতনপুর গ্রামের পলাশ স্থানীয় বিএনপি’র একজন প্রভাবশালী নেতা। আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে বিএনপি কর্মী ও তার সাবেক ব্যবসায়িক পার্টনার টুলু বিশ্বাস সহ আরো কয়েকজন প্রভাবশালী বিএনপি নেতাকর্মীর ছত্রছায়ায় থেকে এখনো ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
মুজিবনগর থানার ওসি মিজানুর রহমান বলেন, কোর্টে বিভিন্ন মামলা হলেও সেগুলো এখনো এফআইআর ভুক্ত হয়নি। আর মুজিবনগর থানাতে আমাম হোসেন মিলু বা তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কেউ কোন মামলা করেনি। এজন্যই তাকে গ্রেফতারের কোন অভিযান চালানো হয়নি।
গত ১৬ বছর আওয়ামী লীগের শাসন আমলে ক্ষমতার দাপটে সাধারণ মানুষ সহ আপন চাচাদের জমি দখল করেছেন। তার দুই চাচা দুদু বিশ্বাস ও নুরুল বিশ্বাসের জমি জোরপূর্বক দখল করে মিলু ও তার ছোট ভাই শিলু বিশাল বাড়ি নির্মাণ করে সেখানে বসবাস করছেন। এখনো পর্যন্ত সেই বসতবাড়ির জমি তার চাচাদের নামেই রেজিস্ট্রিকৃত বলে জানিয়েছেন তাদের কয়েকজন প্রতিবেশী।
মিলু তার অপর চাচা মটর বিশ্বাসের পুকুর ও বাগান সহ ১০ বিঘা জমি জবর দখল করে ভোগ করছেন। নিজ গ্রাম যতারপুর ও পিরোজপুর গ্রামে আমাম হোসেন মিলু অনেকের বসতবাড়ি ও জায়গা জমি দখল তখন নিয়ে ভোগ দখল করছেন বলেও নিশ্চিত করেছে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন গ্রামবাসী। বর্তমানে তার মেহেরপুর শহরে বাড়ি রয়েছে মল্লিক পাড়া ও বাসস্ট্যান্ড পাড়াতে, মল্লিক পাড়াতে কয়েক বিঘা জমিও কিনেছেন সম্প্রতি। শহরের বেড়পাড়ায় তিন বিঘা আয়তনের একটা পুকুর কিনেছেন যৌথভাবে মিলু,শিলু ও বাধন। এছাড়াও সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনের আগে নিজেকে ভারতীয় প্রার্থী বলে বিতর্কিত হওয়া প্রফেসর আব্দুল মান্নানের মেহেরপুর শহরে অবস্থিত জমি কিনে নেন মিলু ও শিলু। আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় মিলু ও তার ছোট ভাই শিলু এবং ভাতিজা বাধন মেহেরপুর জেলাতেই কয়েকশত কোটি টাকার সম্পদ করেছেন।
ওয়ান ইলেভেন পরবর্তীতে ২০০৯ সালে জয়নাল আবেদীন মেহেরপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে ঘনিষ্ঠতা করেন তার সাথে। এখান থেকেই তার ক্ষমতার দাপটের শুরু। ঠিকাদারী ও টেন্ডারবাজিতে মেতে উঠতে শুরু করেন এই সময়। পরবর্তীতে ফরহাদ হোসেন দোদুল সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে তার সঙ্গে আতাত করেন মিলু। আর ফরহাদ হোসেন প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেলে মিলু ফরহাদের স্ত্রী সৈয়দা মোনালিসার সাথে সখ্যতা গড়ে তোলেন। তার সুপারিশে ভাতিজা বাধনকে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি বানান। এরপর চাচা ভাতিজা দুজন মিলে ফরহাদ পত্নী মোনালিসার সান্নিধ্যে থেকে মেহেরপুরে ক্যাসিনো ব্যবসার নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠেন। জেলার প্রায় শতাধিক ক্যাসিনো ব্যবসায়ী তাদের ছত্রছায়ায় চলে আসে। নিয়মিত পেতে থাকেন মাসোহারা। এ সময় আমাম হোসেন মিলু ও তার ভাতিজা ছাত্রলীগ সভাপতি বাঁধন ক্যাসিনো ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কয়েকটি এজেন্ট চ্যানেল বাগিয়ে নেন। প্রথমদিকের ক্যাসিনো কাণ্ডের সহযোগী সাইদুর ও খাদেমুল হত্যাকাণ্ডে মিলু মাস্টারমাইন্ড বলে এলাকায় জোর প্রচার রয়েছে। এদের মধ্যে সাইদুর ছিলেন সাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের স্ত্রী সৈয়দা মোনালিসার ব্যক্তিগত সহকারী, আর খাদিমুল ছিলেন সিটি ব্যাংকের এজেন্ট এবং মেহেরপুরের অন্যতম প্রধান ক্যাসিনো ব্যবসায়ী মুর্শিদ আলম লিপুর ভগ্নিপতি।
সাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের সুপারিশে বড় মেয়ে হীরাকে ঢাকার একটি বেসরকারি ব্যাংকে উচ্চপদে চাকরি নিয়ে দিয়েছেন। আর ২৫ লাখ টাকা ডোনেশন দিয়ে মেজ মেয়ে ডিনাকে ভর্তি করেছেন সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ। মিলু তার মেজ ভাই মুকুলের ছেলে নাহিদ মুজাহিদ বাচ্চুকে মহাজনপুর কলেজে কম্পিউটার প্রশিক্ষকের চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন। গ্রামের সাধারণ কৃষকদের সেচের পানি সরবরাহের জন্য ৫০ লাখ টাকা সরকারি ব্যায়ে নির্মিত ডিপ টিউবয়েলটিও বাগিয়ে নেন বাচ্চুর নামে। এই ডিপ টিউবওয়েল থেকে গ্রামের সাধারণ মানুষ কোন সুবিধা পান না। এটা শুধু মিলু, শিলু, মুকুল ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য ব্যবহৃত হয়। ২০১৬ সালে মিলুর অপর ভাই শিলু তার ছেলে বাঁধন ও বড় ভাইয়ের প্রভাব খাটিয়ে জেলা পরিষদের সদস্য হন।
ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যেয়ে মহাজনপুর ইউনিয়নে পরপর ৩ বার এবং সর্বশেষ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মুজিবনগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
সরকারিভাবে মেহেরপুরের ভৈরব নদ খনন করা হলে সে সময় খননকৃত মাটি বিক্রয় করে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে তার নামে। বিভিন্ন সময়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও জেলা খাদ্য গুদামের কর্মকর্তাদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা ও চড় থাপ্পড় মারার অভিযোগ থাকলেও তিনি থেকে গেছেন আইনের উর্ধ্বে। ২০১৮ সাল থেকে দুদক আমাম হোসেন মিলুর বিরুদ্ধে একটি মামলা করলেও সেটির কোন ফলাফল হয়নি। এছাড়াও মুজিবনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম তোতার অভিযোগে টিসিবির গম আত্মসাৎ করতে যেয়ে ফেঁসে যান তিনি। বিষয়টি নিয়ে এখনো আদালতে মামলা চলমান।
৯০ এর দশকে মিলুর পিতার মৃত্যুর পর তিনি পৈত্রিক সূত্রে মাত্র পাঁচ বিঘা কৃষি জমি পেয়েছিলেন। সমসাময়িক সময়েই তিনি চরমপন্থী সংগঠন পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সাথে জড়িয়ে যায়। সেসময়ের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের চরমপন্থী দলের কুখ্যাত নেতা রুহুল, সবুজ এবং লাল্টুর সাথে তার ছিলো চরম সখ্যতা। ১৯৯৬ সালের দিকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চরমপন্থী দমনে অত্যন্ত তৎপর হয়ে ওঠে, ঠিক সে সময় সরকারের পক্ষ থেকে কোন চরমপন্থী আত্মসমর্পণ করলে তাকে সাধারণ ক্ষমার আওতায় মুক্ত করে দেয়া হবে বলে ঘোষণা দিলে সেই সুযোগকে কাজে লাগান আমাম হোসেন মিলু। গোপালপুর গ্রামের টুলু বিশ্বাসের সাথে পার্টনারে ভূষিমালের ব্যবসা শুরু করেন। প্রায় একই সময় ৯৭ সাল থেকে শুরু করে ২০০০ পর্যন্ত যতারপুর গ্রামের হায়াত সরকারের ছেলে মন্টে সরকারকে সাথে নিয়ে ভারতীয় সীমান্ত দিয়ে স্ক্রাপের ব্যবসা করতেন। এ সময় তার ব্যবসায়িক পার্টনার হয়ে ওঠে ভারতীয় নাগরিক মুকুল সাহা ও তার দল। স্ক্র্যাপ ও ট্রাক এর চেসিস আনা নেওয়ার পাশাপাশি জড়িয়ে পড়েন চোরাকারবারে। ২০০৬ সালে ট্রাকের চেসিস চোরা চালানের সময় ভারতীয় এক ট্রাক মালিককে হত্যা ও ট্রাক চোরাচালানের দায়ে ভারতে কয়েক মাস জেলও খাটেন মিলু। অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় মিলু এবং মুকুল সাহা ও অপর দুই সহযোগীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় ভারতীয় আদালত। তবে ভারতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর মামলা চলককালীন সময়ে তিন মাস পর জামিনে মুক্তি পেয়েছিলেন আমাম হোসেন মিলু।
আমাম হোসেন মিলু ১৯৯৭ সালে তার খালু এবং মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মান্নান মাস্টারের হাত ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ২০০৬ সালে যতাপুর গ্রামের জহির রায়হান ও বাবলু হত্যাকাণ্ডের অন্যতম এজহারভূক্ত ভুক্ত আসামি ছিলেন এই মিলু। হত্যা মামলা দুটিতে গ্রেফতার হয়ে ৩ মাস কারাবরণের পর জামিনে বের হয়ে আসেন। পরবর্তীতে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে মামলার থেকে নিজের নাম সরিয়ে নেন।
অবিশ্বাস্য শোনালেও এটাই সত্য আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরবর্তী সময়েও মিলু তার নিজগ্রাম যতারপুরের গোরস্থান সহ রাস্তর গাছপালা কেটে লুটপাট ও বিক্রি করলেও তার বিরুদ্ধে নেয়া হচ্ছে না কোন ব্যবস্থা।
তবে, সরকার পতনের পর থেকে আত্মগোপনে থাকায় তার কোন বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।