বাংলাদেশে শুরু হয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব সার্বজনীন দূর্গাপুজা। সারা দেশের মত মেহেরপুরে শুরু হয়েছে দূর্গাপূজো। এই করোনাকালীন সময়েও উৎসবের কোন ঘাটতি নেই। যতটা স¤ভব স্বাস্থ্যবিধি মেনেই চলছে অনুষ্ঠানাদি। আজ নবমী। এখানে দূর্গাপুজা নিয়ে দুটি কথা বলার চেষ্টা করেছি।
পুরাণের মতে ব্রহ্মার বরদান পেয়ে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল অসুররাজ মহিষাসুর। যুদ্ধে অসুর বাহিনীর কাছে পরাস্ত হয়ে সিংহাসন হারিয়েছিলেন দেবতা ইন্দ্র। স্বর্গে দেবতাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। সমস্যার সমাধানের জন্য ভগবান বিষ্ণুর দ্বারস্থ হন দেবতারা। কিন্তু মহিষাসুরকে রুদ্ধ করার কোনো কৌশল খুঁজে পাচ্ছিলেন না কেউই। কারণ ব্রহ্মার বরদান অনুযায়ী কোনও পুরুষ বা কোনও দেবতা মহিষাসুরকে বধ করতে পারবে না। সেই কারণেই অসুর নিধনে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরের ত্বেজ থেকে জন্ম হয় ময়ামাহার। হিন্দুশাস্ত্র মতে, কাত্যায়ণ ঋষির আশ্রমে দূর্গার জন্ম হয়েছিল বলে তাঁর আর এক নাম কাত্যায়ণী। আশ্রমেই শুক্লসপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী এই তিনদিন আরাধনার মাধ্যমে দেবীর আবাহন করেন ঋষি কাত্যায়ণ। চতুর্থ দিন অর্থাৎ দশমীতে মহিষাসুরবধ করেন দেবী।
শরৎকালে আশ্বিন মাসে চিরাচরিত দূর্গাপুজো হয়ে থাকে তাই এই উৎসবের আর এক নাম শারদীয়া। কিন্তু রাবণের সঙ্গে যুদ্ধে যাওয়ার আগে দেবী দূর্গাকে তুষ্ট করতে বসস্তকালেই দেবীর আবাহণ করেন অযোধ্যার রাজা রামচন্দ্র। অন্যসময়ে বা অকালে দেবীর বোধন হয় বলে এই পূজা অকাল বোধন নামেই পরিচিত। ১০৮টি নীলপদ্ম দিয়ে পুজো করলে দেবী প্রসন্ন হবেন একথা জানতেন রাম। আর তাই নীলপদ্মের সন্ধানে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ান তিনি। কিন্তু ১০৭টি পদ্ম খুঁজে পান তিনি। বাকি একটি পদ্মের ঘাটতি মেটাতে নিজের একটি চোখ দেবীর কাছে সমর্পণ করার সিদ্ধাস্ত নেন রাম। এহেন শ্রদ্ধায় সন্তুষ্ট হয়ে দেবী রামের সম্মুখে প্রকট হয়ে আশীর্বাদ দেন। যুদ্ধ শুরু হয় সপ্তমীতে। ভয়াবহ যুদ্ধ চলতে থাকে। অবশেষে অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে রামের হাতে মৃত্যু হয় রাবণের। দশমীর দিন রাবণের শবদাহ করা হয়।
বাংলায় কবে ও কারা প্রথম দূর্গাপুজোর প্রচলন করেন তা নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে। ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে জানা যায় ১৫০০ সালে বাংলায় প্রথম দূর্গাপুজো হয়। দিনাজপুর ও মালদহের জমিদাররা প্রথম দূর্গাপুজোর শুরুর পরিকল্পনা নেন। কারও মতে, তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ প্রথম সাড়ম্বরে দূর্গাপুজো শুরু করেন। কারও দাবি নদিয়ার ভাষানন্দ মজুমদার প্রথম শারদীয়া পুজোর সূচনা করেন। মানুষ তার সৃষ্টির জন্য তার বিশ্বাস অনুসারে সাধারণত একজন প্রতিপালকের আনুগত্য মেনে নেয়। আর এ আনুগত্য প্রকাশে কিছু শাস্ত্রীয় মাঙ্গলিক ক্রিয়া কর্মাদিরও প্রচলন আছে। প্রত্যেক ধর্মেরই কিছু ধর্মীয় রীতি ও সংস্কার আছে। যে রীতি ও সংস্কারের মূলে রয়েছে একটি ঐকাস্তিক বিশ্বাস। আর সকল বিশ্বাসের মূলেই বিজ্ঞান নিস্ক্রিয়। কিছু রীতির সমালোচনা থাকলেও অধিকাংশ রীতির ও সংস্কারের উদ্দেশই হলো বিশ্ব ভ্রমান্ডের সকল মানুষ ও প্রাণীর মঙ্গল কামনা। আর সার্বজনীন মঙ্গল কামনায় কোন সংস্কারে হিংসার স্থান নেই। বরং আছে মানবতার বিকাশ, নীতি নৈতিকতা আর ভ্রাতৃত্ববোধের পরম শিক্ষা।
ধর্মীয় আচার ও সংস্কৃতির এ ধারাবাহিকতায় সনাতন ধর্মাবলম্বীরা প্রতি বছরই দেবী দূর্গার পূজা পালন করে আসছে। শারদীয় দুর্গোৎসব রূপ নিয়েছে সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রাণের উৎসবে। তবে এই প্রাণের উৎসবে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই অংশগ্রহণ করে বলে এটা শুধুমাত্র ধর্মীয় উৎসবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। হয়ে উঠেছে সর্বজনীন উৎসবে। যেহেতু বাঙালি উৎসব প্রিয় জাতি, সেহেতু এই দেশের অধিকাংশ অসাম্প্রদায়িক মানুষের সহাবস্থানের কারণেই অনেক বছর ধরেই এই উৎসবে মিলন ঘটে অসংখ্য আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার। এই জন্যই বলা হয়ে থাকে ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। সাধারণত মাটির মুর্তিতে দেবীর আবাহন হলেও পূজা হয় হৃদ মন্দিরে। দেহ-বীণার তন্ত্রীতে বাজবে মঙ্গল ঘন্টা। মঙ্গল দীপের আলোতে আলোকিত হবে মন-প্রাণ। ভজন, পূজন আর আরাধনার আয়োজনে ব্যস্ত হবে ভক্ত প্রাণ। মায়ের পূজা অর্চণা আর ঢাকের শব্দে মুখরিত হবে চারপাশ। মাঙ্গলিক মন্ত্র উচ্চারণের মধ্য দিয়ে কামনা করা হবে বিশ্ব শাস্তির অমিয় বাণী।
শারদীয় দূর্গাপূজা শুরু হয়েছে ২২ অক্টোবর। দোলায় চড়ে দূর্গা দেবী এসেছেন ফিরে যাবেন গজে। সঙ্গে নিয়েছেন গণেশ, কার্তিক, লক্ষী আর সরস্বতীকে। আসছেন তারা ভক্তদের শুভবুদ্ধির পথ দেখাতে। অসুর শক্তির বিরুদ্ধে সুর শক্তির চেতনা জাগাতে। করোনা নামের অসুরকে শেষ করতে দেবী দূর্গা এসেছেন মর্ত্যে। সনাতন ধর্মাবলম্বী বাঙালিদের সবচেয়ে বড় উৎসব দূর্গাপূজা। দূর্গাপূজা বা দুর্গোৎসব হল হিন্দু দেবী দূর্গার পূজাকে কেন্দ্র করে প্রচলিত একটি উৎসব। দূর্গাপূজা সমগ্র হিন্দুসমাজেই প্রচলিত। তবে বাঙালি হিন্দু সমাজে এটি প্রধান ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব। আশ্বিন বা চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষে দূর্গাপূজা করা হয়। আশ্বিন মাসের দূর্গাপূজা শারদীয় দূর্গাপূজা এবং চৈত্র মাসের দূর্গাপূজা বাসস্তী দূর্গাপূজা নামে পরিচিত। শারদীয় দূর্গাপূজার জনপ্রিয়তা বেশি।
দূর্গাপূজা ভারত, বাংলাদেশ ও নেপাল সহ ভারতীয় উপমহাদেশ ও বিশ্বের একাধিক রাষ্ট্রে পালিত হয়ে থাকে। তবে বাঙালি হিন্দু সমাজের প্রধান ধর্মীয় উৎসব হওয়ার দরুন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা রাজ্যে দূর্গাপূজা বিশেষ জাঁকজমকের সঙ্গে পালিত হয়। বাংলাদেশে হিন্দু সমাজেও দূর্গাপূজা বিশেষ উৎসাহের সঙ্গে পালিত হয়।