মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার তেরাইলে ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় তেরাইল-জোড়পুকুরিয়া কলেজ (বর্তমান বঙ্গবন্ধু কলেজ) নামের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কলেজটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাজনৈতিক পালাবদলের সাথে সাথে কলেজ ব্যবস্থাপনা পরিষদেও পরিবর্তন হয়েছে। শিক্ষার মান বৃদ্ধির থেকে ব্যক্তি মতাদর্শের মান বাড়াতে ব্যস্ত সময় পার করেছেন কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ। ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ পড়ুন ১ম পর্ব।
সরেজমিন ও বিভিন্ন অভিযোগের মাধ্যমে জানা গেছে, ২০২১ সালে কলেজের অধ্যক্ষ গোলাম মোস্তফার মৃত্যুও পর থেকে অনিয়ম আর দুর্নীতি ভরে গেছে কলেজটিতে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বিধিকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে ব্যবস্থাপনা পরিষদের সভাপতির মন মত চালানো হয়েছে কলেজটিকে। গোলাম মোস্তফার মৃত্যুর পর আওয়ামী দলীয় প্রভাষক মাসুম উল হক মিন্টুকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেন তৎকালীন সভাপতি বামন্দি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শহিদুল ইসলাম। ৫ জন সিনিয়র শিক্ষককে বাদ দিয়ে ৬ নম্বর সিনিয়র শিক্ষক মাসুম উল হককে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর পর থেকে শুরু হয় নানা দুর্নীতি ও অনিয়ম।
কলেজের উন্নয়নের নামে গভর্ণিং বডির সিদ্ধান্ত মোতাবেক শিক্ষক ও বিভিন্ন স্টাফদের নিয়োগ দিয়ে ৮১ লাখ ৩০ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। এর মধ্যে সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাসুম উল হক ৪৯ লাখ ৩০ হাজার, প্রয়াত অধ্যক্ষ গোলাম মোস্তফা ৩ লাখ ৫০ হাজার, সাবেক সভাপতি শহিদুল ইসলাম ৫লাখ এবং সাবেক এমপি সাহিদুজ্জামান ২৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা উত্তোলন করেছেন। সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাসুম উল হকের কাছে থাকা ৪৯ লাখ ৩০ হাজারের মধ্যে সাবেক এমপি সাহিদুজ্জামান ১৬ লাখ, সাবেক সভাপতি শহিদুল ইসলাম ১২ লাখ টাকা নিয়েছে। এছাড়া ২০ লাখ টাকা দিয়ে ৪৫ শতক জমি কিনেছেন।
৫ আগষ্ট সরকার পালাবদলের পর কলেজটিতেও পালাবদল শুরু হয়। সাবেক অধ্যক্ষ মাসুম উল হককে সরিয়ে সেখানে দায়িত্ব দেওয়া হয় জিনারুল ইসলামকে। তিনিও ৭ নম্বর সিনিয়র শিক্ষক। এ নিয়েও সিনিয়র ৫ শিক্ষকের মধ্যে চাপা ক্ষোভ রয়েছে।
মাসুম উল হক অপসারণ হওয়ার পর কলেজের দুর্নীতি নিয়ে বিভিন্ন খবর ছড়াতে থাকে। শিক্ষক ও স্টাফদের নিয়োগ বাণিজ্য, শিক্ষকদের টিউশন ফিস আত্মসাৎ, সঞ্চয় আত্মসাৎ, অন্যদের জমি দখল নিয়ে কলেজের গেট ও প্রাচির নির্মাণ, কলেজের টাকা দিয়ে সাবেক এমপির স্ত্রীর নামে জমি কিনে দেওয়া, এবং জৌষ্ঠতা লঙ্ঘন করে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিয়োগ নেওয়া নিয়ে কলেজটিতে চলছে নানা গুঞ্জন।
কলেজের শিক্ষকদের নিয়োগ বাণিজ্যের একটি তালিকা ইতোমধ্যে বর্তমান কমিটি ও গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে পৌছে দেওয়া হয়েছে। তালিকায় দেখা গেছে, মাসুম উল হক সহ কলেজের সাবেক দুই সভাপতি ও প্রয়াত অধ্যক্ষ ৮১ লাখ ৩০ হাজার টাকার লেনদেন করেছেন। এর পুরো টাকা তারা তছরুপ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
এতে দেখা গেছে, সাবেক সভাপতি শহিদুল ইসলামের কাছে ভুগোল বিভাগের প্রভাষক সাইফুল ইসলাম ২ লাখ টাকা, পদার্থবিজ্ঞানের প্রভাষক রবিউল ইসলাম ৩ লাখ টাকা, সাবেক সভাপতি ও সাবেক এমপি সাহিদুজ্জামানের কাছে বাংলার প্রভাষক অপর্ণা হক সাড়ে ৬ লাখ টাকা, পরিসংখ্যানের প্রভাষক সুজা উদ্দৌলা ১৫ লাখ টাকা, ল্যাব সহকারী শিমুল হোসেন ২ লাখ টাকা, সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাসুম উল হকের কাছে ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রভাষক শুকচাঁদ আলী ৪ লাখ টাকা, ইংরেজির প্রভাষক মোকছেদুর রহমান ১২ লাখ টাকা, প্রধান লাইব্রেরিয়ান হোসনেয়ারা খাতুন ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা, কম্পিউটার অপারেটর পিংকি আখতার ১০ লাখ, ল্যাব সহকারী জান্নাতুল নাইম ১০ লাখ টাকা, আবু সাইদ ৮ লাখ টাকা, পরিচ্ছন্নতাকর্মী শ্রী পারু ৮০ হাজার টাকা, প্রয়াত অধ্যক্ষ গোলাম মোস্তফাকে সাচিবিক বিদ্যার প্রভাষক মিজানুর রহমান ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা, হিসাববিজ্ঞানের প্রভাষক নাজমুল হুদা ২ লাখ টাকা দিয়ে নিয়োগ নিয়েছেন।
শিক্ষকরা অভিযোগ করে বলেন, সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাসুম উল হক ২০২১ সালে থেকে ২০২৪ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা বোর্ড থেকে প্রাপ্ত ৬লাখ ৯৬ হাজার টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেছেন। এই অর্থ শিক্ষকদের প্রাপ্য হলেও কোন শিক্ষককে এ অর্থ দেওয়া হয়নি। এছাড়া মেহেরপুর রুপালী ব্যাংক শাখায় কলেজের নামে একটি এফডিআর ছিলো ২ লাখ টাকার। যেটি সুদে আসলে ৫লাখ ৩৭ হাজার টাকা হয়েছিলো। গত জুন মাসে সেই টাকা উত্তোলন করে সাবেক সভাপতি শদিুল ইসলাম ও সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাসুম উল হক সুদের ৩ লাখ ৩৭ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছেন। বাকি দুই লাখ টাকা দিয়ে পুনরায় কলেজের নামে এফডিআর করেছেন। শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাবসহ দুটি কম্পিউটার ল্যাবে ৬৪টি ল্যাপটপ ও ডেস্কটপ কম্পিউটার বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু বরাদ্দ পাওয়ার সময় অনেকগুলো ল্যাপটপ সরিয়ে রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে।
বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ জিনারুল ইসলাম বলেন, সাবেক অধ্যক্ষ তার ভাগ্নের বেতন করে দেওয়ায় জাহিদুজ্জামানের টা করেননি। জাহিদুজ্জামানের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে। আমরা জাহিদুজ্জামানের বেতনের ব্যবস্থা করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
কলেজের বর্তমান গভর্ণিং বডির সভাপতি জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, ৮১ লাখ টাকার লিখিত দুর্নীতির কথা আমরা জানতে পেরেছি। এছাড়াও কলেজের টাকা দিয়ে সাবেক সভাপতি ও সাবেক এমপি সাহিদুজ্জামানের স্ত্রী লাইলা আরজুমান বানুর নামে ৪২ শতক জমি কিনে দেওয়া হয়েছে বলেও জানতে পেরেছি। এ ব্যাপারে সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ একটি লিখিত হিসাব দিয়েছেন। আমরা এলাকার গণ্যমান্য মানুষদেও নিয়ে এসব দুর্নীতি হিসাব চাইবো। হিসাব না দিতে পারলে ইউএনও মহোদয়ের পরামশ নিয়ে আইননানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাসুম উল হক বলেন, সরকার পালাবদলে পর গত ১৪ আগষ্ট দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছি। চাপ দিয়ে ৪৯ লাখ টাকার একটি হিসাব করে তারা আমার স্বাক্ষর করিয়ে নিয়েছে। সারা বাংলাদেশের বেসরকারি কলেজে যেভাবে চলে আমিও সেভাবেই চালিয়েছি। কলেজ গভর্ণিং বডির সভাপতি ছিলে সাবেক এমপির স্ত্রী লাইলা আরজুমান বানু। তবে সাবেক এমপিই চালাতেন। তিনি যেভাবে চালিয়েছেন সেভাবেই চলতে হয়েছে। কলেজের টাকা দিয়ে এমপির স্ত্রীর নামে জমি কিনে দেওয়ার বিষয়ে তিনি কিছূ জানেন না।
জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও কলেজ গভর্ণিং বডির সাবেক সভাপতি শহিদুল ইসলাম বলেন, কোন ধরণের দুর্নীতি ও অনিয়মের সাথে আমার সম্পৃক্ততা নেই। যারা বলেছে তারা ঠিক বলেনি। আমি ২০১২ সালে একবার এবং কিছু দিন আগে আরেকবার সভাপতি হয়েছিলাম।
সরকার পরিবর্তনের পর সাবেক সংসদ সদস্য ও গাংনী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো: সাহিদুজ্জামান আত্মগোপনে থাকায় তাঁর সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।