বাংলাদেশের প্লেব্যাক সম্রাট কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী এন্ড্রু কিশোরের মরদেহ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের হিমঘরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
সোমবার রাত ৯টা ৪০ মিনিটে মহানগরীর মহিষবাথান এলাকায় থাকা বড় বোনের বাসা থেকে এন্ড্রু কিশোরের মরদেহে একটি স্ট্রেচারে করে বের করা হয়। এরপর অ্যাম্বুলেন্সে করে তার মরদেহ হিমঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। এসময় ওই বাড়িতে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়।
তার অসংখ্য ভক্ত অনুরাগী ও শুভাঙ্ক্ষী শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়েন। সবাই শেষবারের মত তাকে একনজর দেখতে ভীড় করেন। প্লেব্যাক সম্রাট এন্ড্রু কিশোরের বন্ধু রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. দীপকেন্দ্র নাথ দাস জানান, এন্ড্রু কিশোরের বাবার নাম ক্ষিতিশ চন্দ্র বাড়ই। মায়ের নাম মিনু বাড়ই। এন্ড্রু কিশোর সংসার জীবনে স্ত্রী লিপিকা এন্ড্রু এবং সজ্ঞা (২৬) নামে এক মেয়ে ও সপ্তক (২৪) নামে এক পুত্র সন্তান রেখে গেছেন। তার দুজনই বর্তমানে অস্ট্রেলিয়াতে পড়াশোনা করছেন।
সজ্ঞার পড়াশোনা প্রায় শেষের দিকে। তারা দেশের পথে আছেন। মূলত তারা ফিরলেই এন্ড্রু কিশোরের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের ব্যাপারে দিনক্ষণ ঠিক করা হবে। একই সাথে তাকে সমাহিত করার বিষয়েও সিদ্ধান্ত হবে। তবে রাজশাহীতেই তাকে সমাহিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরিবর্তন হলে তা পরে গণমাধ্যমকর্মীদের জানিয়ে দেওয়া হবে। সেসময় পর্যন্ত তার বন্ধু এন্ড্রু কিশোরের মরদেহ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হিমঘরেই রাখা হবে। রাতেই তার মরদেহ সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। এখন কেবল সন্তানদের জন্য অপেক্ষা।
সন্তানরা যেদিন আসবে- সেদিন এন্ড্রু কিশোরের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে বলেও উল্লেখ করেন সদ্য প্রয়াত এই বরেণ্য শিল্পীর বন্ধু ড. দীপকেন্দ্র নাথ দাস। তবে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে তাকে তার মায়ের পাশেই সমাহিত করা হবে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। মারা যাওয়ার আগে তিনি বলে যান তাকে যেন মায়ের পাশেই সমাহিত করা হয়। আর তার শেষ এই ইচ্ছে পূরণ হচ্ছে। এন্ড্রু কিশোরের বোনের স্বামী ডা. প্যাট্টিক বিপুল বিশ্বাস জানিয়েছেন, এখন তার মরদেহ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হিমঘরে থাকছে। মৃত্যুর আগে এন্ড্রু কিশোর নিজেই বলে গেছেন তাকে যেন মায়ের পাশেই সমাহিত করা হয়। সেই ইচ্ছাই মায়ের পাশেই তাকে সমাহিত করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। তিন্তু কখন সমাহিত করা হবে এটা ঠিক করা হয়নি।
সোমবার সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর। তার মৃত্যুর খবর মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে শোকে মুহ্যমান হয়ে যায় পুরো দেশ। অনেকেই প্রিয় শিল্পীকে একনজর দেখতে রাজশাহীর মহিষবাথান এলাকায় থাকা বড় বোন ডা. শিখা বিশ্বাসের বাড়ির সামনে ভীড় করেন। মরণঘাতী ক্যান্সারের অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে এই বাড়িতেই জীবনের শেষ দিনগুলো কাটিয়েছেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত এই সঙ্গীত তারকা।
বড় বোন ও বোনের স্বামী দু’জনই স্বনামধন্য চিকিৎসক। বাড়িটি একটি অংশেই রয়েছে ক্লিনিক। গত সেপ্টম্বরে ক্যান্সার ধরা পড়ার পর প্রায় নয় মাস সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা নেন দিনি। গত ১১ জুন এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে দেশে ফেরেন। এরপর ঢাকার মিরপুরের বাড়িতে সপ্তাহ খানেক থাকার পর গত ২০ জুন রাজশাহী আসেন। সেই থেকে বড় বোনের বাসাতেই ছিলেন। সেখানে সেবা সুস্রসা চলছিল কিংবদন্তি এন্ড্রু কিশোরের। তাই এখন ওই বাড়িটি ঘিরেই সবার কৌতুহল। এতদিন কিভাবে ছিলেন, কেমন ছিলেন, কি খেয়েছেন, কি বলে গেছেন- একে অপরে কথোপকথনের মাধ্যমে এই সব প্রশ্নই আজ জানার চেষ্টা করছেন সবাই।
উল্লেখ্য, ১৯৫৫ সালের ৪ নভেম্বর রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন এন্ড্রু কিশোর। সেখানেই কেটেছে তার শৈশব ও কৈশোর। এন্ড্রু কিশোর প্রাথমিকভাবে সংগীতের পাঠ শুরু করেন রাজশাহীর খ্যাতনামা ওস্তাদ আবদুল আজিজ বাচ্চুর কাছে। একসময় গানের নেশায় রাজধানীতে ছুটে আসেন।
মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত, আধুনিক গান, লোকগান ও দেশাত্মবোধক গানে রেডিওর তালিকাভুক্ত শিল্পী হন। ১৯৭৭ সালে আলম খানের সুরে ‘মেইল ট্রেন’ সিনেমায় ‘অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তার কেউ’ গানের মধ্য দিয়ে এন্ড্রু কিশোরের চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক যাত্রা শুরু হয়।
সেই শুরুর পর থেকে তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এন্ড্রু কিশোরের খুব জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে- ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’, ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’, ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘আমার বুকের মধ্যে খানে’, ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান’, ‘ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা’, ‘সবাই তো ভালোবাসা চায়’, ‘পড়ে না চোখের পলক’, ‘পদ্মপাতার পানি’, ‘ওগো বিদেশিনী’, ‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা’, ‘আমি চিরকাল প্রেমের কাঙাল’প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
এন্ড্রু কিশোর আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ অন্যান্য অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। এছাড়া সংগীতে অসামান্য অবদানের জন্য দেশ-বিদেশের আরও বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন উপমহাদেশের খ্যাতনামা এই শিল্পী।
সূত্র- বিডি-প্রতিদিন