করোনা মহামারীর কারণে পরীক্ষা ছাড়াই অষ্টম শ্রেণির জেএসসি-জেডিসি এবং এসএসসি ও সমমানের ফলের ভিত্তিতে গতকাল এইচএসসি ও সমমান ২০২০-এর ফল প্রকাশ করেছে সরকার। ফলাফলে শতভাগ শিক্ষার্থী পাস করেছে। জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৬১ হাজার ৮০৭ ছাত্র-ছাত্রী। এই জিপিএ-৫ প্রাপ্তি অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ফল প্রকাশ উপলক্ষে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়াল মাধ্যমে অনুষ্ঠানে যুক্ত হন। পরীক্ষা না নিয়ে মূল্যায়নের মাধ্যমে ফল প্রকাশের কারণে ফলাফলের অপেক্ষায় থাকা ১৩ লাখ ৬৭ হাজার ৩৭৭ জন ছাত্রছাত্রীর সবাই উত্তীর্ণ হয়েছে।
ফলাফল পরিসংখ্যানে দেখা গেছে- গত বছর ১৩ লাখ ৩৬ হাজার ৬২৯ এইচএসসি পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছে ৯ লাখ ৮৮ হাজার ১৭২ জন। শতকরা পাসের হার ছিল ৭৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ। গত বছর জিপিএ-৫ পেয়েছিল ৪৭ হাজার ২৮৬ জন। শতকরা হিসাবে এটি ৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ। এ বছর ১১ দশমিক ৮৩ শতাংশ শিক্ষার্থীর ফলাফলে জিপিএ-৫ এসেছে।
নয়টি সাধারণ শিক্ষাবোর্ডে উত্তীর্ণ ১১ লাখ ৪৫ হাজার ৩২৯ শিক্ষার্থীর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৬১৪ জন। শতকরা ১৩ দশমিক ৪১ শতাংশ শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে। মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডে উত্তীর্ণ ৮৮ হাজার ৩০২ শিক্ষার্থীর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪ হাজার ৪৮ জন। শতকরা হিসাবে এটি ৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে উত্তীর্ণ ১ লাখ ৩৩ হাজার ৭৪৬ শিক্ষার্থীর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪ হাজার ১৪৫ জন। শতকরা হিসাবে ৩ দশমিক ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে।
পাসে এগিয়ে ছাত্ররা : এ বছর ১১টি শিক্ষাবোর্ডে ছাত্র ছিল ৭ লাখ ৬ হাজার ৮৮৫ জন। ছাত্রী ছিল ৬ লাখ ৬০ হাজার ৪৯২ জন। সব পরীক্ষার্থী উত্তীর্ণ হওয়ায় পাসের সংখ্যায় এগিয়ে আছেন ছেলেরা। তবে জিপিএ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এগিয়ে আছেন মেয়েরা। ৭৮ হাজার ৪৬৯ ছাত্র ও ৮৩ হাজার ৩৩৮ জন ছাত্রী জিপিএ-৫ পেয়েছেন। বিদেশের আট কেন্দ্রে ২১৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৬২ জন।
এগিয়ে ঢাকা বোর্ড : বোর্ডভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে- ঢাকা বোর্ডে পরীক্ষার্থী বেশি থাকায় ফলের ক্ষেত্রেও এগিয়ে আছে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড। এ বোর্ডে ৩ লাখ ২৬ হাজার ৪১ জন উত্তীর্ণ হয়েছেন। জিপিএ-৫ প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও এগিয়ে আছে এ বোর্ড। এ বোর্ডে ৫৭ হাজার ৯২৬ জন জিপিএ-৫ পেয়েছে। এ ছাড়া রাজশাহীতে ২৬ হাজার ৫৬৮, কুমিল্লায় ৯ হাজার ৩৬৪, যশোরে ১২ হাজার ৮৯২, চট্টগ্রামে ১২ হাজার ১৪৩, বরিশালে ৫ হাজার ৫৬৮, সিলেটে ৪ হাজার ২৪২, দিনাজপুরে ১৪ হাজার ৮৭১ এবং ময়মনসিংহ বোর্ডের ১০ হাজার ৪০ জন জিপিএ-৫ পেয়েছেন।
সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ে জিপিএ-৫ হারালেন ৩৯৬ শিক্ষার্থী : করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে পরীক্ষা না নিয়ে দুই পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে উচ্চমাধ্যমিকের ফল তৈরিতে ‘সাবজেক্ট ম্যাপিং’ করায় আগের দুই পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেলেও এবার ৩৯৬ জন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পাননি। এ ছাড়া জেএসসি-জেডিসি এবং এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় জিপিএ-৫ না পেলেও এবারের মূল্যায়নের ফলাফলে ১৭ হাজার ৪৩ শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছেন। ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি জানান, জেএসসি ও এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেলেও ২০১৭ সালে এইচএসসিতে ১৭ হাজার ৩৭১ জন, ২০১৮ সালে ৫২ হাজার ৬৩৪ জন এবং ২০১৯ সালে ৪৫ হাজার ৮৬৫ জন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পাননি।
অপরদিকে জেএসসি-জেডিসি এবং এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় জিপিএ-৫ না পেলেও ২০১৭ সালে ৬ হাজার ৯৭৬ জন, ২০১৮ সালে ৪ হাজার ১৫৭ জন এবং ২০১৯ সালে ৮ হাজার ৫৭০ জন শিক্ষার্থী এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছিল বলেও জানান তিনি। শিক্ষামন্ত্রী আরও বলেন, জেএসসি ও সমমান এবং এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার গড় মানের ভিত্তিতে এইচএসসির ফল নির্ধারণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে জেএসসি ও সমমানের ২৫ শতাংশ এবং এসএসসি ও সমমানের ৭৫ শতাংশ গড় নম্বর বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ক্ষেত্রে এসএসসি ও সমমান এবং এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার বিষয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে ফল প্রস্তুত করা হয়। ফল নির্ধারণের লক্ষ্যে বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে আট সদস্য বিশিষ্ট পরামর্শক কমিটি গঠন করা হয়েছিল। পরামর্শক কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে সাবজেক্ট ম্যাপিং করে ফল প্রকাশ করা হয়।
এ ছাড়া উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে গ্রুপ/বিভাগ পরিবর্তনকারী পরীক্ষার্থী, বোর্ড পরিবর্তন পরীক্ষার্থী, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার্থী অনিয়মিত পরীক্ষার্থী, মানোন্নয়ন ও প্রাইভেট পরীক্ষার্থীদের ফল পরামর্শক কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে করা হয়। মন্ত্রী বলেন, এবার এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থীরা ফরম পূরণের সময় যে অর্থ জমা দিয়েছিলেন, পরীক্ষা না হওয়ায় তার কিছু অংশ ফেরত পাবেন তারা।
কলেজে ছিল না শিক্ষার্থীদের কোলাহল-উচ্ছ্বাস : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এইচএসসির ফলাফলেও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল না কলেজগুলোতে। চিরচেনা কোলাহলও ছিল না কলেজের সামনে। করোনা পরিস্থিতিতে এবারের ফল অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছে। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের জমায়েত না হওয়ার নির্দেশনা ছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের।
পাবলিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের ওয়েবসাইট (www.educationboardresults.gov.bd) ও সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বোর্ডের ওয়েবসাইট থেকে ফল পাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। ফল পাওয়া যাবে মোবাইলে এসএমএস করেও। এ জন্য HSC লিখে স্পেস দিয়ে শিক্ষা বোর্ডের নামের প্রথম তিন অক্ষর দিয়ে স্পেস দিয়ে রোল লিখে স্পেস দিয়ে ২০২০ লিখে ১৬২২২ নম্বরে পাঠাতে হবে।
ফলাফলের রিভিউ শুরু ৩১ জানুয়ারি : ঘোষিত এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলে যারা খুশি হতে পারেননি, তারা আগামী ৩১ জানুয়ারি থেকে ফল রিভিউয়ের আবেদন করতে পারবেন। আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ফলাফল রিভিউয়ের আবেদন করা যাবে জানিয়ে গতকাল নোটিস জারি করেছে আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটি। শুধু টেলিটকের প্রিপেইড মোবাইল থেকে ফল রিভিউয়ের আবেদন করা যাবে। ম্যানুয়ালি কোনো আবেদন গ্রহণ করা হবে না।
রিভিউ আবেদন করতে মোবাইলের মেসেজ অপশনে গিয়ে জঊঠ লিখে স্পেস দিয়ে বোর্ডের নামের প্রথম তিন অক্ষর লিখে স্পেস দিয়ে রোল নম্বর লিখে ১৬২২২ নম্বরে পাঠাতে হবে। শিক্ষার্থী প্রতি আবেদন ফি ১২৫ টাকা। শিক্ষামন্ত্রী গতকাল ফলপ্রার্থীদের উদ্দেশে বলেন, যদি মূল্যবোধ তৈরি না হয়, তাহলে শুধু বেশি নম্বর পেয়ে কী হবে। মানবিক গুণে গুণান্বিত হও। চারপাশে তাকাও। মানুষকে ভালোবাস। নীতিনৈতিকতা নিয়ে বেড়ে ওঠ। স্বদেশ প্রেমে উজ্জীবিত হও। নিঃস্বার্থ চিত্তে মানব কল্যাণে নিবেদিত হও।
অভিভাবকদের বলেন, সন্তানদের অসুস্থ প্রতিযোগিতার দিকে ঠেলে দেবেন না। স্বার্থপর হিসেবে গড়ে তুলবেন না। দেশের কল্যাণে, মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত হওয়ার শিক্ষা যদি আপনার সন্তান না পায়, মনে রাখবেন এ শিক্ষা অর্থবহ হবে না। শিক্ষার আসল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হবে। যারা শিক্ষকতা পেশায় আছেন, তাদের দায়িত্ব অনেক অনেক বেশি। মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন নাগরিক তৈরির ক্ষেত্রে আপনারাই রাখতে পারেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। অনুষ্ঠানে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মাহবুব হোসেনসহ বিভিন্ন শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান উপস্থিত ছিলেন।