সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরিতে অর্থনীতির প্রধান হাতিয়ার হতে পারে মেরিটাইম বা সমুদ্র সম্পদের খাত। এই খাত পুরোপরি কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশের রিজার্ভ দাঁড়াতো ২০০ বিলিয়ন ডলারে।
খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ব্লু ইকোনোমি সেলের গবেষণায়ও আসছে নানান সম্ভাবনার তথ্য। শুরুতেই তারা বলছে, ভূরাজনৈতিকভাবে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র বঙ্গোপসাগরে অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে ব্লু ইকোনমি কান্ট্রির এলিট ক্লাবে। এতে সমুদ্রে লুকিয়ে থাকা অপরিমেয় সম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের সামনে তৈরি হয়েছে অর্থনৈতিক উন্নয়নের অমিত সম্ভাবনা।
গবেষণা বলছে, ঐতিহাসিকভাবেই বিশ্বে গুরুত্ব পায় বঙ্গোপসাগর। এর নিচে রয়েছে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের বিশাল মজুত। এরই মধ্যে মিয়ানমারের আরাকান উপকূলীয় এলাকায় বড় বড় অনেক গ্যাস ক্ষেত্রের সন্ধান মিলেছে। এরইমধ্যে এই সমুদ্র অঞ্চলের সম্পদ আহরণে আগে প্রয়োজনীয় জরিপ, অনুসন্ধান ও গবেষণা করা হয়েছে। নিবিড়ভাবে কাজ করছে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জাহাজ বানৌজা অনুসন্ধান এবং বিএনটি খাদেম। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, সমুদ্রসীমা বিজয়ের মাধ্যমে ব্লু ইকোনমির ক্ষেত্রে সমুদ্রে প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ দুই ধরনের সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ পেয়েছে বাংলাদেশ। এরই ধারাবাহিকতায় প্রায় দুবছর গবেষণার পর বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের একান্ত সমুদ্র এলাকায় বিভিন্ন প্রজাতির মূল্যবান উদ্ভিজ এবং প্রাণিজ সম্পদের খোঁজ পায়।
এ গবেষণায় যুক্ত ছিলো যুক্তরাজ্য ও নেদারল্যান্ডসের প্রতিষ্ঠান। এতে দেখা গেছে, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় বিপুল পরিমাণ গ্যাস হাইড্রেট ছাড়াও ২২০ প্রজাতির সি-উইড বা শ্যাওলা, ৩৪৭ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৪৯৮ প্রজাতির ঝিনুক, ৫২ প্রজাতির চিংড়ি, ৫ প্রজাতির লবস্টার, ৬ প্রজাতির কাঁকড়া এবং ৬১ প্রজাতির সি-গ্রাস রয়েছে।
মূল্যবান হাইড্রেট বা মিথেন গ্যাস সম্পর্কে পরারাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরও জানায়, বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় এর জমাট স্তর পাওয়া গেছে। যা ১৭-১০৩ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট প্রাকৃতিক গ্যাস মজুতের সমান। এ বিপুল পরিমাণ গ্যাস হাইড্রেট-এর উপস্থিতি ও মজুতের সম্ভাবনা আগামী শতকে বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের সামগ্রিক চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ অংশে গভীর ও অগভীর সমুদ্রসীমায় মোট ২৬টি ব্লক রয়েছে। সেসব ব্লকে তেল ও গ্যাস রয়েছে কিনা, সেজন্য বাংলাদেশের বাপেক্স ও কয়েকটি বিদেশি কোম্পানি অনুসন্ধান করছে।
১৯৯৬ সালে সমুদ্রের নয় নম্বর ব্লকে সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে গ্যাস উত্তোলন শুরু করেছিল কেয়ার্নস এনার্জি। তবে গ্যাস ফুরিয়ে যাওয়ায় ২০১৩ সালে সেটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। তেল-গ্যাস ছাড়াও বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ অংশে সালফার, মেটালিক মডিউল ও কোবাল্ট পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
সম্প্রতি বঙ্গোপসাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধানে প্রায় সোয়া তিন লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকারী কোম্পানি এক্সন মবিল। প্রতিষ্ঠানটি জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের কাছে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দিয়েছে। সমুদ্রে প্রায় সাত হাজার মিটার পর্যন্ত গভীরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের অভিজ্ঞতা ও সক্ষমতা আছে এক্সন মবিলের। এক্সন দক্ষিণ আমেরিকার দেশ গায়ানাতে মবিল তেল অনুসন্ধান ও উত্তোলন করেছে। এর মাধ্যমে গায়ানা এখন পৃথিবীর অন্যতম তেলসমৃদ্ধ দেশে পরিণত হয়েছে।
প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেল ছাড়াও চুনাপাথর ও মূল্যবান খনিজ বালু; যেমন জিরকন, রোটাইল, সিলিমানাইট, ইলমেনাইট, ম্যাগনেটাইট, গ্যানেট, কায়ানাইট, মোনাজাইট, লিক্লোসিন ইত্যাদি এ রকম ১৭ ধরনের খনিজ বালু রয়েছে বঙ্গোপসাগরে। এ সবের মধ্যে মোনাজাইট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া সিমেন্ট বানানোর উপযোগী প্রচুর ক্লে রয়েছে সমুদ্রের তলদেশে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুসারে, বিশ্বে প্রতিবছর ৮ কোটি ৪৪ লাখ টন খাদ্যের যোগান দেয় সমুদ্র। বিশ্বে মানুষের গ্রহণ করা ক্যালরির ২ ভাগ ও প্রোটিনের ১৫ ভাগের যোগান দিচ্ছে সামুদ্রিক মাছ, উদ্ভিদ ও জীবজন্তু। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘সেভ আওয়ার সি’র তথ্য অনুসারে, প্রতিবছর বঙ্গোপসাগর থেকে ৬০ লাখ টন মাছ ধরা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের জেলেরা ধরতে পারছেন মাত্র ৭ লাখ টন মাছ। বাংলাদেশের জেলেরা সমুদ্র থেকে মূলত বিভিন্ন ধরনের মাছ ও চিংড়িই বেশি ধরেন। কারণ খাবার হিসাবে বাংলাদেশিদের ভেতরে এগুলোর চাহিদাই বেশি।
বাংলাদেশের স্থানীয় বাজারে তেমন একটা চাহিদা না থাকলেও অক্টোপাস, কাঁকড়া বা স্কুইডের মতো বিভিন্ন সামুদ্রিক জলজ প্রাণীও প্রচুর পরিমাণ ধরা হয়। বিদেশে প্রচুর চাহিদা থাকায় এসব মাছ রপ্তানি হয়। বাংলাদেশের সমুদ্র থেকে লাক্ষা, রূপচাঁদা ও কালোচাঁদা, টুনা, ম্যাকারেল, লইটা, চ্যাপা, সামুদ্রিক রিটা, শাপলা পাতা মাছ, তাইল্লা, পোয়া, সুরমা, ইলিশ, ছুরি, ফাইস্যা, সামুদ্রিক বাইন ও কই মিলিয়ে খাদ্য হিসেবে ২শ প্রজাতির মাছ ও চিংড়ি নিয়মিত ধরেন বাংলাদেশের জেলেরা।
সমুদ্র অর্থনীতির সর্বোচ্চ সুফল কাজে লাগাতে সমুদ্রজ্ঞানসমৃদ্ধ প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তি তৈরির জন্যে পাঁচটি সরকারি মেরিন একাডেমি কাজ করছে। রয়েছে বেসরকারি আরও কয়েকটি মেরিন একাডেমি। এনিয়ে বিশেষায়িত জ্ঞান আহরণের জন্য রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি। জাহাজ নির্মাণ শিল্পেও বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষনীয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইদানিং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বলেন, বাংলাদেশ ‘পূর্ব এশিয়া, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, পশ্চিমে চীন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মাঝামাঝি হওয়ায় ভারতীয় অঞ্চলসহ আন্তর্জাতিক ব্যবসা বাণিজ্যের অন্যতম ক্ষেত্র হতে পারে। ভূমিকা রাখতে পারে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক হাব হিসেবে। তিনি আরও বলেন ২০৪১ সালের ভেতর উন্নত বাংলাদেশ এবং স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হবে। বাংলাদেশ যদি প্রতি বছর অযাচিত খরচগুলো কমাতে পারে তাহলে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৯৫ বিলিয়ন ইউএস ডলারে উন্নীত করা বেশি কষ্টের বিষয় নয়। সমুদ্র সীমা এবং সমুদ্র বন্দরের আয় কেক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।