জামায়াত-বিএনপি পরিবার থেকে উঠে এসে মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার আলোচিত-সমালোচিত তরুন উদীয়মান রাজনীতিক সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সাহিদুজ্জামান শিপু। গেল মঙ্গলবার অনলাইন জুয়ায় জড়িত অভিযোগে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করার পর তার সম্পর্কে বেরিয়ে এসেছে বিচিত্রি সব তথ্য। কেউ বলেছে শিপু দানশীল ও পরপোকারী, কেউ বা বলেছে গরীবের বন্ধু, কারো কারো মুখে অনলাইন জুয়াড়ী, টেণ্ডারবাজ, নিয়োগ বাণিজ্যর হোতা। শিপুর সম্পর্কে মানুষের মধ্যে অনেক কিছুই অজানা। অনেকেই বলছে কেই এই শিপু? কিভাবে তার উত্থান এই নিয়ে চলছে নানা আলোচনা আর সমালোচনা। কোটি কোটি টাকার মালিক শিপুর অর্থ সম্পদ হলো কিভাবে? বিভিন্ন অনুষ্ঠানে লাখ লাখ টাকা খরচের উৎস কি?
গাংনীর ধানখোলা ইউনিয়নের আড়পাড়া গ্রামের ফরাজি পাড়ার এক কৃষক পরিবারের সন্তান সাহিদুজ্জামান শিপু। বাল্যকালে ১৯৯৪ সালের ২৯মে সাহিদুজ্জামান শিপুর পিতা আব্দুল কুদ্দুস, দাদা আলতাফ হোসেন মোল্লা ও দুই চাচা চরমপন্থিদের নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হয়। শিশু বয়সে বাবাকে হারিয়ে মায়ের কোলে বেড়ে ওঠে। শিপুর দাদা জামায়াত ইসলামের অন্যতম নেতা ছিলেন। বাপ-চাচারা করতেন বিএনপি। শিপুর নানা আওয়ামী লীগের সক্রিয় রাজনীতিক ছিলেন। পারিবারিক নিরাপত্তার কারনে কারনে শিশু শিপুকে নিয়ে তার মা চলে আসেন গাংনীতে। মামা সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মরহুম কামরুজ্জামান বুড়োর কাছেই লালিত পালিত হন শিপু। সংসারে তার লেখা পড়ার ব্যয়ভার বহনের জন্য সাবেক এমপি মকবুল হোসেনের কাছে নিয়ে যায় প্রয়াত ছাত্র নেতা কামরুজ্জামান বুড়ো। ছাত্র অবস্থায় জড়িয়ে পড়েন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে। মকবুল হোসেনের আর্শিবাদে ছাত্রলীগের জেলা কমিটির সহসভাপতির পদ পান তিনি। রাজনীতির অঙ্গনে লড়াকু সৈনেিকর ভুমিকায় অভিভুত হয়ে সাবেক এমপি মকবুল হোসেন তার পার্সোনাল সেক্রেটারি (পিএস) হিসেবে নিয়োগ করেন। সেই থেকেই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন শিপু। বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে বিত্ত বৈভবের মালিক হন তিনি। টেণ্ডারবাজি ও বিভিন্ন স্কুল কলেজের নিয়োগ বাণিজ্যর মূল হোতা হয়ে উঠে তরুণ শিপু। মকবুল হোসেন এমপির মাধ্যমে বিভিন্ন নিয়োগ ও টেণ্ডারবাজির সবটুকুই দেখভাল করতো শিপু।
সাবেক পৌর মেয়র আশরাফুল ইসলাম সহ অনেককেই নানা ধরনের রোশানলে পড়তে হয়েছে তার কাছে। কথিত আছে মেয়র আশরাফুল ইসলামের কাছ থেকে নানা সময়ে অনেক টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এই সাহিদুজ্জামান শিপু। স্বার্থের টানা পোড়েনের কারনে এক সময় দুজনের মধ্যে শত্রুতা দেখা দেয়। সেই শত্রুতা দিনদিন দানা বেঁধে ওঠে। পরে আশরাফুল ইসলামের সার্থে সম্পর্কের ছেদ পড়ে। বর্তমান এমপি সাহিদুজ্জামানের বিপক্ষে বিভিন্ন সময় মিছিল মিটিং করতে দেখা যায় এই শিপুকে।
গেল জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামীলীগের প্রার্থী সাহিদুজ্জামান খোকন নির্বাচিত হলে মকবুল হোসেনের কাছ থেকে সরে এসে সাহিদুজ্জামান খোকনের আস্থা ভাজন হবার চেষ্টা করেন শিপু। এ চেষ্টায় সফলও হন তিনি। বিভিন্ন সময়ে প্রয়াত কামরুজ্জামান বুড়োর স্বরণে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ব্যয় করেন লক্ষ লক্ষ টাকা। শিপুর সাজানো অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হন মেহেরপুর-২ (গাংনী) আসানেরএমপি মোহাম্মদ সাহিদুজ্জামান খোকন। নিজ খরচে বিভিন্ন মানুষকে অর্থিকভাবে সহায়তা ছাড়াও দান খয়রাতে ব্যাপক পরিচিত পায় গাংনীসহ বিভিন্ন এলাকায়। নিজেকে আগামী দিনের গাংনী পৌর সভার মেয়র হিসেবে তৈরী করার আগাম প্রস্তুতি বটে। কিন্তু তার এই টাকা উড়ানোর বিষয়ে বিভিন্ন মহল আলোচনা সমালোচনা শুরু করে। কিভাবে এই বিত্ত বৈভবের মালিক হন। এই নিয়ে চলে বিত্তশালীদের মধ্যেও নানা গুঞ্জন। সাহিদুজ্জামান শিপুর কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠান কিংবা আয়ের উৎস নেই অথচ কিভাবে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করেন তা নিয়ে আলোচনা শুরু হলে প্রশাসনও নড়ে চড়ে বসেন। শেষ পর্যন্ত প্রশাসনের কাছে বিষয়টি খোলসা হয়। বেরিয়ে আসে অনলাইন জুয়ার চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। বর্তমানে শিপু হাজতবাসে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তজুড়ে এলাকাবাসী জানান, সাহিদুজ্জামান শিপুর দাদা আলতাব হোসেন স্বাধীনতা যুদ্ধের পর দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের সৃষ্ট চরমপন্থিদের আশ্রয় দুর্দান্ত দাপটে এলাকা অস্থির। সেসময় পুলিশ বেশ কয়েকজন চরমপন্থিকে গ্রেপ্তার করলে চরমপন্থিরা ফুঁসে ওঠে। পরে একই রাতে সাত জনকে জবাই করে হত্যা করা হয়। হত্যাকান্ডের শিকার সাত জনের মধ্যে জালশুকা গ্রামের তিনজনসহ শিপুর দাদা, বাবা ও দুই চাচাসহ চারজনকে জবাই করে হত্যা করে চরমপন্থিরা। এ হত্যাকান্ডকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে গ্রামের বর্তমানে গাংনী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোখলেছুর রহমান মুকুল ও তার পরিবারের লোকজনের ওপর চাপিয়ে দিয়ে মামলা করে। অথচ মখলেচুর রহমান মুকুল অন্য একটি মামলায় সেসময় কারাগারে ছিলেন। দির্ঘদিন আদালতে ওই মামলা বিচারাধীন থাকার পর মামলা থেকে অব্যহতি পান মখলেচুর রহমান মুকুল।
আরো একটি সুত্র জানায়, সাহিদুজ্জামান শিপু ভিন্ন ভিন্ন পন্থায় বিত্তবৈভরে মালিক হন। সুত্রটি জানায় উড়তি বয়সের ছেলেদেরকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন কর্মকান্ড চালিয়ে গেছেন। এছাড়া তিনি এলাকায় একজন সুদ ব্যবসায়ী হিসেবেও পরিচিত। এদিকে নিজের রাজনৈতিক ভীত মজবুত করতে বিভিন্নজনকে অকাতরে অর্থদান শুরু করেন। শিপু কত কোটি টাকার মালিক হয়তো সে নিজেও জানে না। স্ত্রীর নামে পোস্ট অফিসে কিছু সঞ্চয় করেছেন। এছাড়া নিজের নামে কোন ব্যাংকে টাকা রাখেননি এমনকি জমিও কেনেননি। তবে ওইসকল টাকা সোনার বার কিনে মজুদ করেছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া মেহেরপুর গাংনী, কুষ্টিয়ার কিছু এলাকার মাদকের নিয়ন্ত্রণ করেন এই সাবেক ছাত্র নেতা। এছাড়া রয়েছে নারী কেলেঙ্কারীতে পারদর্শিতার অভিযোগও।
মাদক, সন্ত্রাস ও অনলাইন জুয়াড়ি বিষয়ক শিপুর বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগও রয়েছে। এরপর বিষয়টি নিয়ে নড়ে চড়ে বসে প্রশাসন। শেষ পর্যন্ত তার অনলাইন জুয়ার আখড়ায় হানা দেয় পুলিশ। শুধু শিপুই নয়, তার সাথে তার আরো পাঁচজন সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে। বেরিয়ে পড়ে থলের বিড়াল। সম্প্রতি গাংনী বাজারে ককটেল বিস্ফোরণ ও উদ্ধারের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় শিপু নিজেই বাদী হয়ে গাংনী থানায় ১১ জনের নামে একটি মামলা করেন। ওই মামলায় বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতা কর্মী গ্রেপ্তার হন। একটি সুত্র জানায়, শিপু নিজেই একজন অঘটন ঘটন পটিয়শি। নিজেই ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বিএনপির ওপর দায় চাপিয়েছেন। প্রশাসনও বিষয়টি আচ করতে পেরে গোপন তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছেন বলেও জানা গেছে। তবে এব্যাপারে প্রশাসনের দায়িত্বশীল কর্মর্তারা মুখে কোলুপ এঁটেছেন।
অপর একটি সুত্র জানায়, শিপু সাবেক এমপি মকবুল হোসেনের আশির্বাদপুষ্ট হয়ে তাঁর কাছে থেকে শিক্ষা গ্রহন ও রাজনীতিতে তার পদার্পন। তাই সাবেক এমপি মকবুল হোসনে কে তিনি কোনদিনই পরিত্যাগ করেননি। বর্তমান সংসদ সদস্য ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি মোহাম্মদ সাহিদুজ্জামান খোকনের সাথে মিশে থেকে কফিনের শেষ পেরেকটি মারতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিধি বাম। অনলাইন জুয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়ার পর এই কুটকৌশলের পখথটি রুদ্ধ। অনলাইন জুয়ার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে তার ব্যাক্তিগত কার্যালয় থেকে শিপুসহ আরো পাঁচ জনকে গ্রেপ্তার করা হলে তার অফিস এলাকা এখন সুনশান নিরবতা। এর শেষ দেখার অপেক্ষায় আছেন অনেকেই। শিপু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় বর্তমানে কারান্তরীণ। সহসা জামিন না পেলেও জামিনে যখন বের হবেন তখনও কি তার দাপট থাকবে, না কী শিক্ষা নিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবেন তা দেখার অপক্ষোয় গাংনীবাসী।
এদিকে, শিপু আটকের পর তাকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পদধারী অনেক নেতা প্রশাসনের কাছে সুপারিশ করেছেন। কিন্তু পুলিশ অনড় থাকায় কোন সুপারিশ কাজে আসেনি।
আজ রবিবার শিপুর রিমাণ্ড আবেদনের উপর শুনানী হওয়ার কথা রয়েছে।