ঢাকাই সিনেমার অমর নায়ক সালমান শাহর রহস্যঘেরা মৃত্যু নিয়ে মামলার তদন্তকারী সংস্থা পিবিআইয়ের (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) কাছে ২১টি প্রশ্ন রেখেছেন তার মা নীলা চৌধুরী। এসব প্রশ্নের পিবিআই উত্তর দিয়েছে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির মহাপরিচালক বনজ কুমার মজুমদার।
সোমবার ধানমণ্ডিতে পিবিআই কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ তথ্য জানান।
সংবাদ সম্মেলনে ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, সালমান শাহর মামলা তদন্ত করতে গিয়ে তার মাকে আমরা কয়েক দফা অনুরোধ করেছি আপনি আসলে কী চান। কোন কোন বিষয়ে তার কোয়েরি আছে সেগুলো জানতে চেয়েছি। তিনি আমাদের ২১টি প্রশ্নের একটি তালিকা দিয়েছেন। প্রতি পৃষ্ঠায় তার স্বাক্ষর আছে। আমরা মোটামুটি সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছি।
নীলা চৌধুরীর প্রশ্ন ও পিবিআইয়ের জবাব নিম্নে দেয়া হলো-
নীলা চৌধুরী: ডিবি ডিসি বলেছেন– এই মৃত্যু নিয়ে তার সন্দেহ আছে।
পিবিআই: ডিসি বলেছেন– আমি এমন ফালতু কথা কেন বলব? আমি নিশ্চিত হয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছি।
নীলা চৌধুরী: যদি পুলিশি মামলা হয়, তবে বাসার লোক পুলিশকে কল করেনি কেন?
পিবিআই: এটি নিয়ে সবাইকে প্রশ্ন করা হয়েছে। তারা বলেছেন– আমরা দিশেহারা এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় ছিলাম। আমাদের মনে হয়েছে সালমান বেঁচে আছে। এ জন্য পুলিশকে বলিনি।
নীলা চৌধুরী: সালমানের সুরতহাল প্রতিবেদনে মৃত্যুর সময়ের কথা বলা হয়নি কেন?
পিবিআই: যারা সুরতহাল প্রতিবেদন করেছেন, তারা বলেছেন– মৃত্যুর সময় সকাল ৭টা থেকে ১০টা।
নীলা চৌধুরী: সব সাজানো নাটক। মরদেহের সুরতহাল রিপোর্ট মিথ্যা, সেখানে কোনো দাগটাগের কথা ছিল না।
পিবিআই: সুরতহাল প্রতিবেদনে নীলা চৌধুরীর স্বামী, তার ছেলে ও বাদল খন্দকার স্বাক্ষর করেছিলেন।
নীলা চৌধুরী: হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল কীভাবে বুঝল সালমান আত্মহত্যা করেছে?
পিবিআই: চিকিৎসকরা বলেছেন– পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই তারা নিশ্চিত হয়েছেন। যেহেতু পুলিশ কেস, সুতরাং ঢাকা মেডিকেলে যেতে হবে এখানে লাশ রাখার কোনো সুযোগ নেই।
নীলা চৌধুরী: পোস্টমর্টেমের আগে ইসিজি করতে হয়, সেটি করা হয়নি, ডেথ সার্টিফিকেট নিতে হয়, সেটিও নেয়া হয়নি কেন?
পিবিআই: এ বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল বলেছে– ইসিজি করা ছাড়া ডেথ ডিক্লেয়ার করার সুযোগ নেই। এটি একটি রেগুলার প্রসেস, এটি পোস্টমর্টেমে থাকে না। সালমান শাহর ব্যাপারে দফায় দফায় এটি করা হয়েছে। পিবিআই ডেথ সার্টিফিকেটটি সংগ্রহ করেছে।
নীলা চৌধুরী: ময়নাতদন্তকারী ডোম রমেশের বরাত দিয়ে বলছেন, রমেশ যখন বলে– সালমান ভাই আত্মহত্যা করেনি, তখন ডাক্তাররা তাকে বলছে¬ চুপ কর, কাজ শেষ কর।
পিবিআই: রমেশ ১৬৪ ধারায় করা জবানবন্দিতে জানিয়েছেন, তিনি এসব বলেননি।
নীলা চৌধুরী: পোস্টমর্টেম হলো মিথ্যা, পোস্টমর্টেম হলে বুক কাটা থাকে, মাথা কাটা থাকে। কাটার দাগ নেই কোনো?
পিবিআই: ডাক্তার তেজেন্দ্র বলেছেন– যেহেতু তিনি সেলিব্রেটি, দেশসেরা নায়ক বিভিন্ন জায়গায় জানাজা হবে, অনেকেই দেখতে আসবে; এ জন্য তিনি কসমেটিক সার্জারি করেছেন। যে কারণে দাগটি বোঝার কোনো কারণ নেই।
নীলা চৌধুরী: সালমানের চিঠিটা কোত্থেকে এলো (মৃত্যুর আগে লিখে যাওয়া চিরকুট), কীভাবে এলো। এটি সামিরা নিজে লিখেছে।
পিবিআই: অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, এটি ওই বাসায় কাজ করা আবুল ও মনোয়ারা পায়। সালমানের প্যান্ট চেঞ্জ করার সময়। এটি এসআই মাহবুব জব্দ করেছে সামিরার কাছ থেকে।
নীলা চৌধুরী: ঘটনার পর সামিরা, তার বাবা ও মা কেন সালমান শাহর লাশের সঙ্গে সিলেটে যায়নি।
পিবিআই: সামিরা জানিয়েছে, তার শ্বশুর তাকে বলেছে– তুমি গেলে তোমাকে মারধর করবে। তুমি যেও না। এই কারণে ভয়ে তার মা-বাবা অপমান হতে পারে ভেবে লাশের সঙ্গে তারা যাননি।
নীলা চৌধুরী: ভিকিকে (রুবির ছেলে) দিয়ে সব আলামত সরিয়ে ফেলেছে সামিরা।
পিবিআই: ভিকিকে দিয়ে সালমানের মা ও রুবি দরজা খুলে মালামাল নিয়ে যেতেন।
নীলা চৌধুরী: রাতে ফোনটা শাবনূরের ছিল না অন্য কেউ করেছিল। সামিরা সেটি জানত বলেই ফোনটি ভেঙে ফেলেছে। ফ্যানটিও আজিজ মোহাম্মদ ভাই ভেঙেছে। ফ্যানের তার দিয়ে পেঁচিয়ে সালমানকে খুন করা হয়েছে।
পিবিআই: সামিরা বলেছে– ফোনটি শাবনূর করেছে। আমরা ধরে নিয়েছি সামিরা সত্য বলেছে। এ ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই। ফোন ও ফ্যান ভাঙা আবুল (বাসার কাজের লোক) দেখেছে। আবুল পিবিআইকে বলেছে তার সামনে ভেঙেছে।
নীলা চৌধুরী: সকালে সালমানকে বাবার সঙ্গে দেখা করতে দেয়নি সামিরা।
পিবিআই: বাবা চলে যাওয়ার পর সালমান ঘুম থেকে উঠেছে। ইন্টারকমে কথাও বলেছে। এটি মালি দেখেছে, মনোয়ারা দেখেছে। আরও অনেকেই দেখেছে।
নীলা চৌধুরী: অক্ষত সেই ফ্যানটা আলামতে ছিল না কেন?
পিবিআই: কেন নেয়নি তা আমাদের জানা নেই। আমরা ফ্যানটি আলামতে নিয়ে নিছি।
নীলা চৌধুরী: পরিচালকরা শেষে গিয়ে কয়েকটি সিনেমায় তাকে (সালমান) দিয়ে আত্মহত্যার সিনেমা দেখাত। এটির কারণেই এমন হয়েছে। সেই সময় এটার যুগ ছিল।
পিবিআই: এ বিষয়ে কারও সাক্ষ্য আনা হয়নি। তারাই জানেন কেন দেখিয়েছে?
নীলা চৌধুরী: সালমানের বন্ধু সামিরাকে বিয়ে করায় প্রমাণ করে যে, সে পরকীয়ায় আসক্ত ছিল।
পিবিআই: এর কোনো প্রমাণ আমরা জোগাড় করতে পারিনি। কেউই স্বীকারও করেনি। সবাই বলেছে পারিবারিকভাবে বিয়ে।
নীলা চৌধুরী: ময়নাতদন্ত রিপোর্ট ফাইলে নেই।
পিবিআই: ময়নাতদন্ত রিপোর্ট খুঁজে পেয়েছি।
সোমবার সকালে রাজধানীর ধানমণ্ডিতে পিবিআই কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে সালমান শাহ হত্যার নেপথ্যের কারণগুলো তুলে ধরেন পিবিআইয়ের (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) মহাপরিচালক ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার। তিনি বলেন, সালমান শাহ হত্যার অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ মেলেনি। সালমান পারিবারিক কলহে আত্মহত্যা করেছেন।
উল্লেখ্য, ১৯৯৩ সালে ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবি দিয়ে দেশীয় চলচ্চিত্রে আগমন ঘটে সালমান শাহর। স্মার্টনেস-গ্লামার ও পারসোনালিটির কারণে রাতারাতি তরুণ প্রজন্মের আইকনে পরিণত হয়ে ওঠেন এ নায়ক। মাত্র সাড়ে তিন বছরের ক্যারিয়ারে ২৭টি ছবি করেন। যার অধিকাংশই সুপারহিট। মৌসুমীর সঙ্গে জুটি বেঁধে চলচ্চিত্র অঙ্গনে পা রাখলেও সালমানের বেশিরভাগ ছবির নায়িকা শাবনূর। এই জুটি তখন এমন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে, যে কোনো ছবি মুক্তি পেলেই দর্শক প্রেক্ষাগৃহে হুমড়ি খেয়ে পড়তেন। একপর্যায়ে শাবনূরের সঙ্গে বিবাহিত সালমানের সম্পর্ক নিয়ে গুঞ্জন ওঠে। এর পর কলহ দেখা দেয় সালমানের পরিবারে।
১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সালমানের মৃত্যু হয়। সেই থেকে তার মৃত্যু নিয়ে ধোঁয়াশা ছিল। হত্যা নাকি আত্মহত্যা? অবশেষে পিবিআই জানাল, আত্মহত্যা করেছিলেন সালমান।
১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সালমানের রহস্যজনক মৃত্যুর পর এ বিষয়ে অপমৃত্যুর মামলা করেন তার বাবা কমরউদ্দিন আহমদ চৌধুরী। ১৯৯৭ সালের ৩ নভেম্বর আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় সিআইডি। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে সালমান শাহর মৃত্যুকে ‘আত্মহত্যা’ বলে উল্লেখ করা হয়। সিআইডির প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে কমরউদ্দিন আহমদ চৌধুরী মহানগর দায়রা জজ আদালতে রিভিশন আবেদন করেন।
২০০৩ সালের ১৯ মে মামলাটি বিচার বিভাগীয় তদন্তে পাঠানো হয়। প্রায় ১২ বছর পর ২০১৪ সালের ৩ আগস্ট বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। তাতেও সালমান শাহর মৃত্যুকে ‘অপমৃত্যু’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
২০১৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি নীলা চৌধুরী ঢাকা মহানগর হাকিম জাহাঙ্গীর হোসেনের আদালতে বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে নারাজির আবেদন দাখিল করেন। নারাজি আবেদনে উল্লেখ করা হয়, আজিজ মোহাম্মদ ভাইসহ ১১ জন তার ছেলে সালমান শাহের হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকতে পারেন।
মামলাটি এর পর র্যা ব তদন্ত করে। তবে র্যা বের দ্বারা তদন্তের আদেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ গত বছরের ১৯ এপ্রিল মহানগর দায়রা জজ আদালতে একটি রিভিশন মামলা করে। ২০১৬ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বিশেষ জজ ৬-এর বিচারক ইমরুল কায়েস রাষ্ট্রপক্ষের রিভিশনটি মঞ্জুর করেন এবং র্যা বকে মামলাটি আর না তদন্ত করার আদেশ দেন। তার পর মামলাটির তদন্তভার যায় পিবিআইয়ের হাতে।
দীর্ঘ তদন্তের পর সোমবার পিবিআই জানাল সালমানকে হত্যা করা হয়নি। তিনি আত্মহত্যা করেছেন।
সুত্র-যুগান্তর