প্রত্যেক মানুষের একটি সহজাত প্রবৃত্তি হলো অন্যের কাছে নিজেকে গ্রহণযোগ্য ও আকর্ষণীয় করে তোলা। অতীতে মানুষ নিজের মেধা, বুদ্ধি, আচার-আচরণ ও ব্যক্তিত্ব না দর্শনগত উপস্থাপনার মাধ্যমে অন্যের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করত। কিন্তু বর্তমানে প্রযুক্তির অভাবনীয় পরিবর্তনের ফলে নিজের গ্রহণযোগ্যতা তৈরির জন্য প্রযুক্তিগত পন্থাকে ব্যবহার করছে। এসব পন্থার মধ্যে অন্যতম হলো মোবাইল অ্যাপস টিকটক, ফেসবুক রিলস, ইন্সটাগ্রাম। এই সব অ্যাপসের মাধ্যমে ১৫ সেকেন্ড, ৩০ সেকেন্ড যেকোনো ভিডিও তৈরি করা যায় এবং যা খুব সহজেই তা অন্য কোনো সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করা যায়। আবার অন্য কারো তৈরি করা কোনো গান বা অভিনয়ের মধ্যে ঠোঁট মিলিয়ে নিজের অভিনয়শৈলী প্রকাশ করা যায় টিকটকের মাধ্যমে।
টিকটক একটি মোবাইল এ্যাপস হলেও এর নেতিবাচক প্রভাব তরুণ প্রজন্মকে বিশেষ করে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে বাস্তব থেকে। এদের মধ্যে উগ্রতা, অশালীনতা, অশ্লীলতা, কল্পনাপ্রবণতার মতো বিভিন্ন জটিল মানসিক রোগ তৈরি করছে। অতিরিক্ত টিকটকের ব্যবহারের ফলে মানসিক ভারসাম্যহীনতা, বাস্তবতার প্রতিবিমুখতা, মনস্তাত্ত্বিক অবক্ষয় ও চারিত্রিক অবনতির মতো ভয়ানক জটিল মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। সামগ্রিকভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে।
টিকটক অ্যাপসের ব্যবহারের কারণে এমন কিছু নেতিবাচক ঘটনা ঘটেছে, যার ফলে ভিডিও আপলোডকারীকে জীবনের ইতি টানতে হয়েছে। প্রায়শই পত্রিকার বদৌলতে জানা যায়, টিকটক ভিডিও বানাতে যেয়ে ট্রেনে নিচে কাটা পড়ে কিশোরের মৃত্যু বা ভিডিও বানাতে যেয়ে ট্রেনে উপর থেকে পড়ে যুবকের মৃত্যু। প্রাইমারী স্কুলে পড়া ছাত্রী ভিডিও বানাতে গিয়ে মৃত্যু। এমন খবর হরহামেশাই শোনা যায়। বস্তুত শিশু-কিশোর, তরুণ কিংবা বৃদ্ধ কেউই বাদ পড়ছে না টিকটক আসক্তি থেকে। শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ এসব ভিডিও তৈরি কিংবা উপভোগ করতে গিয়ে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়কে হারিয়ে ফেলছে নিজের অজান্তেই। যে সময়ে তাদের সিলেবাস শেষ করার কথা, সে সময়টাতে তারা টিকটক নামের এই অপ্রয়োজনীয় এবং সময় অপচয়কারী প্লাটফর্মে নিজেদের বিলিয়ে দিচ্ছে।
টিকটক নতুন মিডিয়া। তরুণ সমাজ এর সঙ্গে কতটুকু কীভাবে যুক্ত সেই বিষয়গুলো দেখার আছে। পাশাপাশি এর ইতিবাচক দিকও তো আছে। আমাদের যারা নীতিনির্ধারক অনেক সময় তাদেরও বোঝাপড়ায় ঘাটতি থাকে। তারা ক্রিটিক্যালভাবেই বিষয়টা দেখে। টিকটকের সবাই মনে করে, বখাটেরাই এটা ব্যবহার করে। এটা কোন ভদ্র মানুষের কাজ না। টিকটককে যে ধরনের কনটেন্টের মধ্যে ফ্রেমিং করা হয়, টিকটক কিন্তু সেই ধরনের কনটেন্টের মধ্যে সীমাবদ্ধ না। সেখানে কিন্তু ভালো কনটেন্টও থাকতে পারে। অনেকে ভালো কনটেন্টও বানাচ্ছে। সেটা মজার হতে পারে, শিক্ষামূলক হতে পারে, বিনোদনমূলক হতে পারে। সেই সুস্থ্য বিষয়টা এখানে অনেক ক্ষেত্রেই মিসিং হয়ে যায়। খারাপের দিকেই মানুষের আগ্রহ বেশি।
টিকটক, ইনস্টাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাট, ফেসবুক, ইউটিউব সব জায়গায় এই শর্ট ভিডিও কনটেন্টের ছড়াছড়ি। বিনোদন নেওয়ার বাহানায় রিলসে ঢুঁ মারার স্বভাবও হয়ে গেছে ব্যবহারকারীদের। অথচ কয়েক সেকেন্ডের এই রিলসগুলোই কাজ করার ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে, মনোযোগ কেড়ে নিচ্ছে অজান্তে, বিষণ্নতা উপহার দিচ্ছে, মানসিক অশান্তির কারণ হয়ে যাচ্ছে। কীভাবে করছে এসব ক্ষতি হচ্ছে হচ্ছে ?
সামাজিক মাধ্যমের স্ক্রলিং ক্যাফেইনের নেশার মতো। অফুরন্ত কনটেন্ট ডোপামিনের ফিডব্যাক লুপ সৃষ্টি করে। যা থেকে মনোযোগ সরানো একেবারেই সহজ নয়। এভাবে শুধু সময়ই অতিবাহিত হয় না, বরং কাজের ক্ষমতাও চলে যেতে থাকে আঙুলের স্পর্শের সঙ্গে সঙ্গে।
রিলস আকারের ছোট ভিডিওগুলো একেতো সংক্ষিপ্ত, চটকদার, তেমনি আবার বিভ্রান্ত করার ক্ষেত্রেও চমৎকার। র্যাপিড ফায়ার ফরম্যাটের রিলসগুলো কোনোকিছু মনেই রাখতে দেয় না। কয়েকটি ভিডিও দেখার পর কোন ভিডিওর পর কোনটি মনে থাকা দুষ্কর। কয়েকটি মনে পড়লেও অধিকাংশই স্মৃতি থেকে হারিয়ে যায়। কারণ রিলস প্যাসিভ ভিউকে উৎসাহিত করে, যেখানে কোনো ভিডিও স্থায়ী প্রভাব ফেলে না। রিলস স্বল্পমেয়াদী স্মৃতির মতো ক্ষণস্থায়ী। আর অস্থায়ীত্ব ভুলে যাওয়ার প্রবণতা বাড়িয়ে দেয় ভীষণভাবে। উদ্দেশ্য ছাড়া স্ক্রল করতে থাকলে জ্ঞানীয় ক্ষমতা ও মনোযোগ দুর্বল করে দেবে ব্যাপক হারে। চলমান ডিজিটাল বিপ্লবকালে নৈতিক উদ্বেগ নিয়ে সমালোচনা করতে গেলেও রিলসের প্রভাব অবহেলা করা যাবে না। রিলসের রোলারকোস্টার মানসিক সুস্থতার ওপরও প্রভাব ফেলছে।
ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামেও রয়েছে রিলস, ইউটিউবে শর্টস। আলাদা নাম হলেও জিনিস কিন্তু একই। কনটেন্টগুলো হয় খুবই আকর্ষণীয়। এই শর্ট ভিডিও গুলো , আস্তে আস্তে মানুষকে আবেগশূন্য করে দিচ্ছে, কারও মৃত্যুর খবরে এখন আমাদের কষ্টের স্থায়িত্বকাল মাত্র ৩ সেকেন্ড, কোনো দুর্ঘটনার খবর আর আমাদের শরীরকে অসার করে দেয় না, মনে কষ্ট নিয়ে আঙুলের ইশারায় ফোনস্ক্রিন স্ক্রল করে নিচে নেমে কোনো কৌতুকপূর্ণ রিলে পরমুহূর্তেই আমাদের ঠোঁট প্রসারিত হয়, চোখে আনন্দের ছাপ পরিলক্ষিত হয়, আমরা পরিণত হই আবেগহীন, যন্ত্রমানবে…
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন বহু মানুষের উপার্জনের একটা ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। আর এই উপার্জন করতে লাইক, ভিউ বেশি লাগে। বেশি ভিউ বা লাইক পেতে দ্রুত জনপ্রিয় হয় এমন সব কনটেন্ট তৈরি করছে তরুণেরা। পাশাপাশি নিজেকেও গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে জাহির করার একটা চেষ্টা আছে। এই কাজ করতে গিয়ে তারা এমন সব কনটেন্ট তৈরি করছে যা বাংলাদেশে আইনে অপরাধ।
সস্তা জনপ্রিয়তা সমাজে নতুন করে দেখা দিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া আসার পরই এটা বেশি করে দেখা যাচ্ছে। যারা সোশ্যাল মিডিয়ায় কনটেন্ট তৈরি করে তারা বেশি লাইক বেশি ভিউ মাথায় রাখে। এটার দুটো দিক আছে। একটা সরাসরি অর্থনৈতিক দিক, আরেকটি হল সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেকে জাহির করা। নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে উপস্থাপন করা। অর্থনৈতিক দিকটা হল, কারও পেজে যদি অনেক লাইক বা কনটেন্টে অনেক ভিউ হয় সেটা ফেসবুক বা ইউটিউবে বা অন্য কোন মিডিয়ায় তাহলে সেটা মনিটাইজ করা সম্ভব। সেখান থেকে অর্থ উপার্জন করাও সম্ভব। এই অপশনটার কারণে মানুষ এখন বেশি ভিউ, বেশি লাইকের পিছনে ছুটছে। এই বিষয়গুলো সাম্প্রতিক সময়ে ব্যবহারকারীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। এখানে যতটা না অর্থনৈতিক তার চেয়ে বেশি মনস্তাত্ত্বিক। কারণ তারা নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে জাহির করতে চান।
সম্প্রতি ভাইরাল খ্যাত ক্রিম আপা বা কিরিম আপার বেশ কিছু ভিডিও টিকটিক বা ফেসবুকে আসছে। কখনো কড়া রাসায়নিকে মেয়ের চুল রং করে দিচ্ছেন। কখনো মাথার চুল ন্যাড়া করে দিচ্ছেন। কান ফুটো করার বন্দুকের মতো যন্ত্র দিয়ে কান ফুটো করে দিচ্ছেন। কানে ভারী কানের দুল পরিয়ে কড়া মেকআপ করাচ্ছেন। বাজে গালি দিচ্ছেন, মেয়ের মুখের সামনে থেকে খাবার কেড়ে নিচ্ছেন, মেয়ের মুখে কুলি ফেলাসহ, ধমক দেওয়া, ঘুমন্ত মেয়েকে ঠেসে খাওয়ানো, চড় মারাসহ নানা কাজ করে যাচ্ছেন ক্যামেরার সামনে। শুধু মাত্র ভিউ পাওয়ার আশায় একজন মা এমন নির্দয়মূলক কাজ করে যাচ্ছেন।
আবার উদ্যোক্তার কথা না বললেই না। রোবাইত ফাতিমা তনি ফেসবুকে পণ্য নিয়ে লাইভে এসে অশালীন ভাষায় গালাগালি করে। কখনো আবার লাইভেই সালোয়ার পরে দেখাচ্ছেন। বয়সের অসামঞ্জস্য স্বামীকে লাইভে এনে সুগার ড্যাডি খ্যাতি দিয়ে দর্শকের মন মাতিয়ে ভিউ বাড়াচ্ছে। কখনও আবার মায়া কান্না করে পণ্য বিক্রি করছেন।
তবে একটু ভালো করে খেয়াল করলে বোঝা যায় এরা মানসিকভাবে অসুস্থ। ভিডিওর কমেন্ট বক্স ভরে বাজে কমেন্টে। এদের কাছে একটাই মুখ্য বিষয় হল ভাইরাল হলেই ভিউ। এই ভিউ কনসেপ্ট প্রজন্মকে আকৃষ্ট করে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে ।
এখন প্রশ্ন হতে পারে সোসাল মিডিয়ার কারণে কী তরুণরা অপরাধমূলক কাজে উৎসাহিত হচ্ছে?
সোশ্যাল মিডিয়া হল বিজনেস মডারেট সামাজিক নেটওয়ার্ক। প্রথমে বিষয়টা এমনই ছিল। উৎসাহিত করার বিষয়ে সরাসরি তাদের দায়ী করতে পারবেন না। ওরা চায় যে কোনো প্রকারে মানুষ এটাতে যুক্ত থাকবে। যত ব্যবহারকারী বাড়বে তত তাদের লাভ। সেজন্য তারা সিস্টেমটাকে সেভাবে সেট করে। যে কনটেন্টগুলো মানুষ বেশি দেখে সেগুলোকে তারা সামনে এনে দেয়। পরোক্ষভাবে দায়ী হলেও সরাসরি বলা যাবে না। এখানে ব্যক্তির দায় যেমন আছে, তেমনি সমাজের অপরাপর মানুষেরও দায় আছে। একটা খারাপ ভিডিও এত ভাইরাল হবে কেন? এখানে সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে শিক্ষারও একটা দিক আছে। ঠিকমতো বোঝার একটা বিষয় আছে। চটকদার কিছু হলেই আমরা সেটাতে ক্লিক করি। এখানে ব্যবহারকারী হিসেবেও আমাদের একটা দায়িত্ব আছে এবং বোঝার ব্যাপার আছে। আমি কিন্তু একটা জিনিস দেখলাম আর সেটা শেষ হয়ে গেল, তেমন না। এখানে আমারও কিন্তু দায় আছে।
আমরা যখন কৈশোর পেরিয়েছি তখন পর্ণ বা পর্ণগ্রাফি শব্দ শুনলেই আড়ষ্ট হয়ে যেতাম। কিন্তু এখন এই বিষয় নিয়ে নেই কোনো আড়ষ্টতা, নেই সহজাত লজ্জা। বরং ছোট বাচ্চাদের থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্কদের মাঝে পর্ণগ্রাফিতে আসক্তির মাত্রা ভয়াবহ আকারে বেড়ে চলেছে। এর কারণ হলো ইন্টারনেটে এসব ভিডিও বা অডিওর সহজলভ্যতা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন ব্লগ, রিলস, টিকটক ভিডিওর উসকানিমূলক প্রচারণা।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অন্যের আনন্দময় মুহূর্ত উপভোগ করতে করতে নিজের অবস্থার সঙ্গে অহেতুক তুলনা করছি আমরা। কোনো ট্রেন্ড দেখলে তা অনুকরণ করার প্রতিযোগিতা নেমে পড়ছি? অথচ কারোর জীবনই মসৃণ নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সকলে ইতিবাচকতা তুলে ধরে। মুদ্রার বিপরীত দিকের চিত্র কখনো দেখা যায় না রিলসে। এতে করে অসন্তুষ্টি ও বিষণ্নতা জাপটে ধরছে।
তবে টিকটক রিলসের মাধ্যমে একাকিত্ব কাটানোর উপায়, ব্যবসার বিজ্ঞাপন, পণ্যের প্রচার, সচেতনতামূলক তথ্য পাওয়া যায় তা মানতে হবে। তবে এটির বিনিময়ে ইনফ্লুয়েন্সার, ভøগারদের কনটেন্ট আমাদের থেকে যে প্রতিদান নিচ্ছে তা বিস্তর বটে। আদান-প্রদানের এই ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার আগেই বাস্তবতা প্রাধান্য দিয়ে চলতে হবে। যতটুকু সম্ভব কাজে ব্যস্ত থেকে রিলসের আসক্তি এড়িয়ে চলতে হবে। মনে রাখবেন, সুন্দর মেকি জীবন নয়, অসুন্দর বাস্তবতাই আমাদের সঙ্গী। বর্তমান সময়ে আমাদের আপন সমাজের কেমনতর অবয়ব তা সচেতন সামাজিক মাত্রেরই জানা। তথাপি নানাবিধ অপরিহার্য ব্যস্ততা হেতু আপন স্বার্থেই আপন চেহারা অবলোকন করে নেওয়া একান্ত বাঞ্ছনীয়।