অন্তর্বর্তী সরকারের হাত ধরে শিগগিরই বাংলাদেশে প্রবেশ করতে যাচ্ছে স্যাটেলাইভিত্তিক দ্রুত গতির ইন্টারনেট সেবা স্টারলিংক। এর ফলে শিপিং ও রিমোট এরিয়াতেও মিলবে ইন্টারনেট সেবা। তবে এই ভালোর মাঝেও সেবা গ্রহীতাদের চিন্তার কারণ এখন স্টারলিংকের গাইডলাইন। কেননা, স্টারলিংকের খসড়া গাইডলাইনে নজরদারি ও আড়িপাতার সুযোগ রাখা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা ও ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট অ্যাফিসিয়েন্সির প্রধান ইলন মাস্কের মালিকানাধীন স্টারলিংক বাংলাদেশে এ সেবা চালু করতে প্রস্তুত। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এ নিয়ে একটি খসড়া গাইডলাইন তৈরির কাজ শেষ করেছে। এখন এর ওপর মতামত সংগ্রহের কাজ চলছে। বিটিআরসি জানিয়েছে, গাইডলাইন চূড়ান্ত হলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে স্টারলিংক সেবা চালু করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশে পরীক্ষামূলক সরবরাহ শেষ হলে তাদের সঙ্গে ইন্টারনেটের দাম নিয়ে আলোচনা হবে।
এ খাতের বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবার জন্য রেগুলেটরি ও লাইসেন্সিং নীতিমালা চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে খসড়া গাইডলাইন তৈরি হয়েছে। খসড়ায় নজরদারি ও আড়িপাতার সুযোগ রাখা হয়েছে। তারা বলেছেন, নজরদারির বিষয়টি শেষ পর্যন্ত বহাল থাকলে ইন্টারনেট সেবার ওপর সরকারের খবরদারির সুযোগ অব্যাহত থাকবে। অপরদিকে আইএসপি ব্যবসায়ীরা বলেছেন, এ ইন্টারনেটের ব্যয় বেশি হওয়ায় হোম ইউজার পর্যায়ে গ্রাহকরা তেমন আগ্রহী হবেন না।
টেলিকম বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, স্টারলিংক বাজারে এলে বর্তমানে ইন্টারনেট নিয়ে দেশে যে মনোপলি ব্যবসা ও হয়রানি চলছে, সেটি ভেঙে যাবে। গ্রাহকরা কম টাকায় আরও দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা পাবে। একই সঙ্গে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল তথা দুর্গম এলাকায় পৌঁছে যাবে ইন্টারনেট সেবা। স্টারলিংকের ইন্টারনেট সেবায় গ্রাহকরা অনলাইন বাফারিং, গেমিং এবং ভিডিও কলিংয়ের মান ভালো পাবেন।
জানা যায়, স্টারলিংক ছোট উপগ্রহের একটি অ্যারের মাধ্যমে সীমাহীন উচ্চগতির ডেটা অফার করে, যা প্রতি সেকেন্ডে ১৫০ মেগাবিট (এমবিপিএস) ইন্টারনেট গতি সরবরাহ করে। স্পেসএক্স আগামী মাসে এ হার দ্বিগুণ করারও পরিকল্পনা গ্রহণ করছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ইন্টারনেটের সর্বোচ্চ গতি ২৫ এমবিপিএসের মতো। বিশ্বের দ্রুতগতির ইন্টারনেট প্রদানকারী ১০৮টি দেশের মধ্যে বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান ৯০তম।
স্টারলিংক কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশের বাজারে এ সেবা নিয়ে ঢোকার চেষ্টা করে আসছিল। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইলন মাস্ককে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান এবং দেশে স্টারলিংক পরিষেবা চালুর প্রস্তাব দেন। একই সঙ্গে ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে বাংলাদেশে স্টারলিংক স্যাটেলাইট ইন্টারনেট পরিষেবা চালুর প্রস্তাব দেন। দেশে দ্রুত স্টারলিংকের পরিষেবা চালুর উদ্দেশ্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার বিশেষ প্রতিনিধি (রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলিসংক্রান্ত) ড. খলিলুর রহমানকে মাস্কের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার দায়িত্ব দিয়েছেন। ১৩ ফেব্রুয়ারি ইলন মাস্ক ও ড. ইউনূসের মধ্যে টেলিফোনে দীর্ঘ আলোচনা হয়। এ আলোচনায় স্টারলিংক স্যাটেলাইট ইন্টারনেট পরিষেবা চালু করা এবং ভবিষ্যৎ সহযোগিতার বিষয়গুলো উঠে আসে।
এদিকে মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, স্টারলিংকের মাধ্যমে ইন্টারনেট শাটডাউনের ঘটনা চিরতরে বন্ধ করা হবে। পোস্টে তিনি লেখেন, শেখ হাসিনার স্বৈরতন্ত্র ১৬ বছরে বহুবার ইন্টারনেট বন্ধ করেছে। বিক্ষোভ দমন কিংবা কোনো বড় ধরনের আন্দোলন দমানোর জন্য স্বৈরশাসক ও একনায়কদের প্রিয় হাতিয়ার হলো ইন্টারনেট শাটডাউন। এ প্রক্রিয়ায় লাখো ফ্রিল্যান্সার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অনেকেই চিরতরে তাদের চুক্তি ও কাজ হারিয়েছেন। প্রেস সচিব আরও বলেন, বাংলাদেশের বাজারে স্টারলিংক প্রবেশের অর্থ হলো ভবিষ্যতে কোনো সরকার ইন্টারনেট পুরোপুরি বন্ধ করতে পারবে না।
আড়িপাতার বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিটিআরসি এ সংক্রান্ত যে খসড়া গাইডলাইন তৈরি করেছে তাতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা হয়েছে। ‘নন-জিওস্টেশনারি অরবিট (এনজিএসও) স্যাটেলাইট সার্ভিসেস অপারেটর’ শীর্ষক ওই গাইডলাইনে এ বিষয়ে বলা হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়, যে লাইসেন্স পাবে তার সিস্টেমে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে-এমন ব্যক্তিদের শনাক্তকরণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। এর মাধ্যমে যাতে সরকারি কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় তথ্য পেতে পারে।
সরকারি কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের গেটওয়েগুলোয় এখন যে কোনো সময় প্রবেশ করতে পারে। ঠিক একইভাবে ‘আড়িপাতার প্রক্রিয়ায় ডেটা দেওয়ার’ ব্যবস্থা রাখতে হবে। অর্থাৎ এর মাধ্যমে গ্রাহকদের ওপর আড়িপাতার সুযোগ থেকেই যাবে। এছাড়া খসড়া গাইডলাইন অনুযায়ী আড়িপাতাসংক্রান্ত সরকারের যে নীতি, সেটিও প্রতিষ্ঠানগুলোকে মেনে চলতে হবে। পাশাপাশি বেআইনি কার্যকলাপ বা নাশকতা শনাক্তের প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মানতে হবে। ইন্টারনেট প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি আনোয়ারুল আজিম গণমাধ্যমকে বলেন, স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেটের ব্যয় বেশি হওয়ায় হোম ইউজার পর্যায়ে প্রভাব কম পড়বে। তবে করপোরেট গ্রাহকরা সেদিকে ঝুঁকতে পারে। সেক্ষেত্রে আইএসপিরা কিছু গ্রাহক হারাবে। তবে দেখতে হবে যে সরকার কোন পর্যায়ে কী ধরনের রেস্ট্রিকশন দিয়ে লাইসেন্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। শিপিং ও রিমোট এরিয়ার জন্য স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট দরকার আছে। আমরা দেখব কীভাবে সেই পরিকল্পনা করা হয়।
সূত্র: ইত্তেফাক