কাছে ছিল দইয়ের ভাড়, সেটি ভাঙেনি, অক্ষত ছিল মিষ্টির প্যাকেট ও মাছের ব্যাগও। কিন্তু এই সামগ্রি গুলোর মালিক আক্তারুল ইসলাম সড়ক দুর্ঘটনায় মাথা থেতলিয়ে মারা গেলেন। আক্তারুলের দুই সহযাত্রীও অক্ষত ছিলেন। ঘটনার পর থেকে তারাও আত্মগোপনে ছিলেন তাদের বহনকারী গম মাড়াইকরা হুপার নিয়ে।
এ ধরণের একটি ঘটনা পাঠকদের মনে নানা প্রশ্ন তৈরি করবে? পাঠকরা ভালভাবে উপলব্ধি করার চেষ্টা করবেন এটি নিছকই দুর্ঘটনা নাকি হত্যা?
পুলিশ এটিকে সড়ক দুর্ঘটনা বলে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিলেও নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে সিআইডিকে পুন:তদন্ত দেওয়ার দাবি করে আদালতে আবেদন করা হয়েছে।
নিহতের পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, আক্তারুলের দুই সহযাত্রী কামাল হোসেন ও বাহারুল ইসলাম পরিকল্পিতভাবে তাকে ধাক্কা দিয়ে গম মাড়াইকরা হপারের নিচে ফেলে দিয়েছে। আর হপারের চাকার নিচে মাথা পড়ে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়েছে।
ঘটনার বিবরণে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ৫ অক্টোবর ঘটনাটি ঘটে মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার বাওট গ্রামের আব্দুল গনি ডিগ্রী কলেজের কাছে। সে সময় অজ্ঞাত ট্রাকের ধাক্কায় আক্তারুলের মৃত্যু হয় বলে প্রচার করা হয় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা সহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এ বিষয়ে একটি মামলাও হয় অজ্ঞাত ট্রাক চালকের বিরুদ্ধে।
ঘটনার ৪ মাসের মাথায় বেরিয়ে আসলো চাঞ্চল্যকর তথ্য। ট্রাকের ধাক্কায় না চড়ে থাকা হপারের নিচে পড়ে তার মৃত্যু হয়। সেসময় ঘটনা ধামাচাপা দিয়ে ফেলে সাথে থাকা কামাল ও বাহার নামের দুইজন।
নিহতের পরিবারের দাবি সাথে থাকা দুইজন কামাল ও বাহার পরিকল্পিতভাবে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে হত্যা করেছে। এ নিয়ে এলাকায় সালিস বৈঠক হলে সেখানে কামাল ও বাহারের কথায় সন্দেহ আরো ঘনিভূত হয়।
পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষকে হারিয়ে তিন সন্তান নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে মৃত আক্তারুলের স্ত্রী সাহিনা খাতুন। এই সুযোগটি কাজে লাগানোর জন্য কামাল সাহিনাকে ৬০ হাজার টাকা নিয়ে বিষয়টি চেপে যাওয়ার কথাও বলে।
গাংনীর হিজলবাড়ীয়ার গ্রামের আক্তারুল ইসলাম এর স্ত্রী সাহিনা খাতুন বলেন, গত বছরের ৫ অক্টোবর হিজলবাড়ীয়া গ্রামের আশরাফুল ইসলামের ছেলে কামাল ও গোপালপুর গ্রামের মৃত ইসলামের ছেলে বাহার আলী আমার স্বামী আক্তারুলকে সাথে নিয়ে সিরাজগজ জেলার তালাশ নামক এলাকায় যায় গম মাড়াই হপার মেশিন কেনার জন্য। মেশিন কিনে ফিরে আসার সময় গাংনী উপজেলা বাওট গ্রামের আব্দুল গনি ডিগ্রী কলেজের কাছে হপার গাড়ী থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে মেরে ফেলে। পরে তার লাশ ফেলে হপার গাড়ী নিয়ে পালিয়ে কামাল ও বাহার। আমি ফেসবুক ব্যবহার কারী দের মাধ্যমে জানিতে পারি যে আমার স্বামীর লাশ বাওট গ্রামের আব্দুল গনি ডিগ্রী কলেজের কাছে পড়ে আছে। পরে গাংনী থানা পুলিশ লাশ উদ্ধার করে মেহেরপুর মর্গে পাঠায়।
সাহিনা খাতুন আরো জানান, আমার স্বামীর লাশ ফেলে রেখে কামাল হোসেন ও বাহার আলী রক্তাক্ত হপার গাড়ী নিয়ে পালিয়ে জোড়পুকুরে এক আত্মীয়র বাড়ি যায়। সেখানে গাড়ীতে রক্ত দাগ দেখে বাড়ীর মালিক তাদের চলে যেতে বলে। সেখান থেকে ফিরে ভোমরদা গ্রামের কামাল হোসেনের দুসম্পর্কের এক ভাইরার বাড়িতে চার দিন অবস্থান করে।
ঘটনার চার দিনের মাথায় আমার স্বামীর মৃত্যুর জন্য দোয়ার আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এমন সময় সংবাদ পেলাম আমার স্বামীর মৃত্যু বিষয়ে আশমত আলীর বাড়িতে সালিশ হচ্ছে। সেখানে আমি উপস্থিত হই এসময় কামাল জনরোসে পড়ে স্বীকার করে আক্তার তাদের হপার গাড়ির নিচে পড়ে মারা গেছে।
পরে কামাল আমার বাড়িতে এসে আমাকে ৬০ হাজার টাকা দিতে যায়। কিন্তু সে টাকা আমি ফেরত দিই।
এরই মধ্যে কামাল ও বাহার পুলিশ প্রশাসন ম্যানেজ করে হত্যাকে আত্মহত্যা বলে কাগজপত্রে আমাদের সাক্ষর করে নেই।
নিহতের বড় ছেলে শাকিল হোসেন বলেন, আমাকে পুলিশের মাধ্যমে থানায় নেওয়া হয়। পরে একটি কাগজে সাক্ষর করতে বলে। আমি না বুঝে সাক্ষর করে দিই। পরে আমরা আসল ঘটনা জানতে পেরে আদালতের মাধ্যমে ঘটনার তদন্ত দাবি করেছি।
এদিকে অভিযুক্ত কামাল হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, আমরা ৩ জন একই গাড়ীতে ছিলাম। কিন্ত আক্তার কে ট্রাকে ধাক্কা মারে ।এসময় সে নিচে পড়ে গিয়ে তার মাথার উপর দিয়ে চাকা চলে যায়।
তবে বাহার আলী এই বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
মামালার তদন্তকারী কর্মকর্তা গাংনী থানার এসআই মকবুল হোসেন জানান, আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছিল অজ্ঞাত ট্রাকের বিরুদ্ধে। আমি সে মোতাবেক তদন্ত করেছি। বিভিন্ন সিসি টিভি ফুটেজসহ স্থানীয় বেশ কিছু সাক্ষিদের সাক্ষ্য গ্রহন করে তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করি। এখন যে বিষটি উঠে আসছে সে বিষয়ে আমার কোন কিছু জানা নেই।
গাংনী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ওবাইদুর রহমান জানান, আক্তারুল ইসলামের মৃত্যু ট্রাকের ধাক্কাতেই হয়। নিহতের পরিবার থেকে যে অভিযোগ করা হয়েছে তা ঠিক নয়।