ভিক্ষা করে পাওয়া হাজার টাকার চেয়ে ব্যবসা করে দুইশ টাকা রোজগার অনেক সম্মানের ঠেলা গাড়িতে গ্রাম ও শহর ঘুরে ভিক্ষা করে ৪০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা রোজগার করতাম। সে রোজগারে কোন বরকত ছিলনা। ছিলনা সম্মান। অনেক সময় পরিচিত লোক দেখে লজ্জায় মাথা নুইয়ে যেতো। ভিক্ষা করা খুবই লজ্জার একটি পেশা। ধর্মীয় ভাবেও এ পেশায় স্বীকৃতি নেই। ভিক্ষার টাকা থেকে সংসার চালিয়ে কিছু টাকা সঞ্চয় করে রাখতাম । আমি এখন আর ভিক্ষা চাইনা। এখন আমি ব্যবসা করি জীবন বদলের কথা গুলি বলছিলেন মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার হিজলবাড়িয়া গ্রামের মৃত পিয়ারুল ইসলামের প্রতিবন্ধী ছেলে সাগর আহম্মেদ। তিনি ১৫ বছরের ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে এখন ব্যবসা করে সংসার চালাচ্ছেন। তার জীবন বদলের কথা শুনে অনেকেই বাহবা দিচ্ছেন আবার সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন অনেকেই।
সাগর আহাম্মেদের বয়স এখন ৩০ বছর। জন্ম থেকেই শারীরীক প্রতিবন্ধী। দুটি পা একেবারেই অকেজো। হাত দিয়ে ঠেলা গাড়ি চড়ে চলাফেরা করতে হয় তাকে।
চার মাস বয়সে সাগররের বাবা মারা যায়। দুই বছর বয়সে মা মুনজিরা খাতুন অন্যত্র বিয়ে করে চলে যান অন্যের সংসারে। নানির সংসারে সাগর আহাম্মেদ বড় হয়ে ওঠে। সাগরকে লালন পালন করে বড় করেছেন বৃদ্ধা নানি মদিনা বেগম। ১৫ বছর বয়সে জীবন জীবীকার তাগিদে ঠেলা গাড়িতে করে গ্রামে গ্রামে ভিক্ষা করতেন। ভিক্ষাবৃত্তি করে কোনদিন ৪০০ টাকা আবার কোনদিন ৫০০ টাকা রোজগার হতো। এ দিয়েই বৃদ্ধা নানিকে নিয়ে সংসার চালাতো সাগর আহাম্মেদ। ভিক্ষা করতে যেয়ে নানা প্রতিকুলতার মধ্যে পড়তে হতো তাকে। দু’টি পা তার অকেজো হওয়ায় দুই হাত দিয়ে পায়ের কাজটি করতে হয় তাকে। সকালে ঘুম থেকে উঠে বাসিপান্তা খেয়ে সাগরকে ঠেলা গাড়িতে তুলে দিতেন নানি মদিনা বেগম। সারাদিন ভিক্ষা শেষে বাড়ি ফিরতেন সন্ধে হলে। এভাবে ১৫ বছর ভিক্ষার ঝুলি বইতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে ওঠে সাগর আহাম্মেদ। অবশেষে স্থানীয়দের পরামর্শে নিজের কিছু জমানো টাকায় গ্রামেই একটি ছোট দোকান দিয়ে বসেছেন তিনি। দোকানে বাইসাইকেলের পার্টসপাতি বিক্রি করেন। নানি ও তার দুজনের সংসারে ব্যবসায় তাদের জীবীকার একমাত্র মাধ্যম্।
সাগর আহাম্মেদ জানায়, ছোট বেলায় বাবা মারা গেলে মা অন্যত্র বিয়ে করে আমাকে নানির কাছে রেখে চলে যায়। নানা বেঁচে না থাকায় নানিও বৃদ্ধা বয়সে কাজ কর্ম করতে পারতো না। বাধ্য হয়ে আমাকে ভিক্ষা পেশায় নামতে হয়েছে। ভিক্ষা করে ৫০০ টাকা রোজগার করতাম। এখন আমি ভিক্ষাবৃতি করিনি।গাংনী শহর থেকে একটি দোকান থেকে বাইসাইকেলের পার্টসপাতি পাইকারি কিনে নিয়ে খুচরা বিক্রি করি।
এখন দোকানদারি করে দুএকশো টাকা যা লাভ হয় তা দিয়েই সম্মানের সাথে জীবন চালাতে পারছি। এখন মনে হয় ৫০০ টাকার চেয়ে আমার এখনকার ২০০ টাকা অনেক বরকতের।
সাগর আহাম্মেদের নানি মদিনা বেগম জানান, ছোট বেলায় সাগররের বাবা মারা যায়। তখন সাগরের মা মুনজিরার বয়স খুবই অল্প। বিধবা মেয়ে ঘরে রাখা খুবই কষ্টের। তাই তার ইচ্ছে না থাকা সত্বেও অন্যত্র বিয়ে দিতে হয়েছে। ছোট বেলা থেকেই সাগরকে আমি মা বাবার আদর স্নেহ দিয়ে বড় করেছি। পরের বাড়িতে কামলার কাজ করে আমরা দুজন সংসার চালাতাম। পরে আমার অনেক বয়স দেখে কেউ কাজে নিতে চাইতানা। বাধ্য হয়েই সাগরকে ভিক্ষার ঝুঁলি হাতে নিতে হয়েছিল। এখন সাগর আর ভিক্ষা করেনা। গ্রামের একটি মোড়ে বাইসাকেলের পার্টসপত্র বিক্রি করে। এখান থেকে যা আয় হয় তা দিয়েই আগের চেয়ে অনেক ভাল আছি।
সাহারবাটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাঃ মশিউর রহমান জানান, সাগর আহাম্মেদ অগে ভিক্ষা করতো জানতে পেরে তাকে ভিজিডি ও ভিজিএফ এর সুবিধা দেয়া হচ্ছে। মাঝে মধ্যে তার খোজ খবর নিই। তবে এমন পরবির্তন খুবই ভাললাগার বিষয়। ৩০ বছরের যুবক তার পেশা পরিবর্তন করে নিয়ে নিজেকে অত্ননির্ভশীল করে সংসার চালাচ্ছে এটি একটি উদাহরণও বটে।
গাংনী উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মোঃ আরশাদ আলী জানান, সাগর আহাম্মেদকে প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড করে দেয়া হয়েছে। এছাড়াও ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে বিভিন্ন সহযোগীতা দেয়া হয়। তবে ১৫ বছর ধরে যে সাগর ভিক্ষা করেছে। সেই সাগর নিজেকে পরিবর্তনের জন্য সমাজে মাথা উচিয়ে বাঁচার জন্য এখন ব্যবসা করছে। এমন উচ্ছা শক্তি সকলের মধ্যে তৈরী হলে ভিক্ষুকের সংখ্যা থাকবেনা। এর পরেও সরকারি কোন সুবিধা এলে সাগার আহাম্মেদরে কথা আমাদের মনে থাকবে। শুধু সাগর নয়, অন্যরাও ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে ব্যবসায় আসলে তাদের পুনর্বাসন করা হবে।