অবহেলা আর অযত্নে শহীদ হামিদের কবর, টয়েলেটের পাশে শহীদ মিনার, নেই বিদ্যালয়ের কোন উন্নয়ন
সুষ্ঠ শিক্ষার পরিবেশ, শিক্ষার মানউন্নয়ন ও প্রতিষ্ঠানের ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন না হলেও, উন্নয়ন হয়েছে গুটিকয়েক শিক্ষকের অর্থনৈতিক অবস্থার। মেহেরপুর কবি নজরুল শিক্ষা মঞ্জিলের কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি থেকে পাওয়া অর্থ প্রধান শিক্ষকসহ সিণ্ডিকেটের পকেটে গেলেও হয়নি বিদ্যালয়ের কোন উন্নয়ন।
মেহেরপুরের ঐতিহ্যবাহী এই বিদ্যালয়টির লেখাপড়ার মান দিনদিন এতটাই নিম্নগামী যে, বিদ্যালয়টিতে কোনো সচেতন মহল এখন তাদের সন্তানদের ভর্তি করাতে চাননা। অবস্থা এখন এমন যে, শিক্ষার্থী কমতে কমতে সংকটে স্কুলটি। স্বয়ং একথাটি জানিয়েছেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সানজিদা ইসলাম।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বিদ্যালয় ক্যাম্পাসের চারদিকে ঝোঁপ জঙ্গলে লতাপাতায় ভরে গেছে। খেলার মাঠটি ছোট ছোট কাগজ, মাঝে মাঝে খানা খন্দে ভরা ময়লা আর আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। বিদ্যালয়ের পূর্ব পাশে টয়লেটের সামনেই রয়েছে শহিদ মিনার। আর দক্ষিণ পাশে এই বিদ্যালয়ের গর্বিত সন্তান শহীদ আব্দুল হামিদের কবর থাকলেও সেটি এখন ভগ্নদশায় পরিণত হয়েছে।
শহীদ আব্দুল হামিদ এই বিদ্যালয়ের প্রাক্তণ ছাত্র হলেও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অবহেলায় এই শহীদের কবরটি এখন বিলীনের পথে। ২৫/৩০ কোটি টাকার সম্পদ থেকে প্রতি বছর ১০/১৫ লক্ষ টাকা আয় হলেও বিদ্যালয়ের অবকাঠামো কোনো উন্নয়ন করা হয়নি। প্রধান শিক্ষকের রুমে জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি থাকলেও ছবি দুটি না টানিয়ে রেখে প্রধান শিক্ষকের রুমের এক কোনায় রাখা আলমিরার উপর অযত্নে রাখা হয়েছে। আজো গড়ে ওঠেনি বিদ্যালয়ের চারদিকে বাউন্ডারী প্রাচীর। এখনো খোলা রয়েছে তিনপাশ। সাম্প্রতিক সময়ে জেলা পরিষদ ২ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে বলে জানান প্রধান শিক্ষক। সে টাকায় এই প্রথম পতাকা স্ট্যান্ড ও বিদ্যালয়ের পশ্চিম পার্শের বাউন্ডারী প্রাচীর দেওয়া হবে বলেও জানান প্রধান শিক্ষক সানজিদা ইসলাম।
মেহেরপুর প্রতিদিন কার্যালয়ে দেওয়া একটি চিঠিতে নাম প্রকাশ না করে কয়েকজন শিক্ষক জানান, গোপনে সোনালী ব্যাংকে আরেকটি এ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। সেখানে বিভিন্ন অনুদানের টাকা জমা করা হয়। এ্যাকাউন্টটি পরিচালনা করেন প্রধান শিক্ষক ও একজন জুনিয়র শিক্ষক। বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী। শিক্ষকদের মন্ত্রীর ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রাখা হয়। গত ১১ মাস বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরিণ বেতন শিক্ষকদের দেওয়া হয়নি। শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচনের সময় শিক্ষকদের ভোট নেওয়া হয়। গোপনীয়তা রক্ষা করে ব্যবস্থাপনা কমিটিও গঠণ করা হয়। কোন শিক্ষক প্রতিবাদ করলেই সাসপেণ্ড করার ভয় দেখানো হয়।
বিদ্যালয়ের ২০১৮ সালের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল দেখা গেছে, ৪৭ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ২৩ জন পাশ করে। এই ফলাফলে দেখা গেছে, বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ ফোর পেয়েছে মাত্র ১ জন, জিপিএ ৩.৫ পেয়েছে ৩ জন, ৩.০০ পেয়েছে ২ জন, কলা বিভাগে জিপিএ ৩.৫ পেয়েছে ১ জন, ৩,০০ পেয়েছে ২ জন, বানিজ্য বিভাগে জিপিএ ৩.৩০ পেয়েছে ১ জন ও ২.০০ পেয়েছে ১ জন মাত্র। অন্যান্য বছরেও একই পরীক্ষার ফলাফল একই রকম বলে জানান শিক্ষার্থীরা।
স্থানীয়রা জানান, বারবার শহীদ আব্দুল হামিদের কবরটি বাঁধার জন্য কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানালেও সে অনুরোধ কোনো কাজে আসেনি। উপেক্ষিত থেকেছে কবরটির বাধার অনুরোধ। অথচ, বিদ্যালয়ে মেহেরপুরের পিচ কমিটির চেয়ারম্যান সাবদার আলী মৃত্যু বার্ষিকী ও জন্ম বার্ষিকী পালন করা হয়েছে নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে, এমন অভিযোগ স্থানীয়দের।
একটি বিশস্থ সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতন, সেশন ফি, জেএসসি এবং এসএসসির রেজিষ্ট্রেশন ফি ও পরীক্ষার ফরম পূরণ বাবদ অতিরিক্ত অর্থ আদায়সহ বিভিন্ন খাত থেকে ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।
সূত্রটি জানায়, শিক্ষার্থীদের নম্বরপত্র ও সনদ বিতরণে অবৈধভাবে অর্থ গ্রহণ, অষ্টম ও নবম শ্রেনীর রেজিস্ট্রেশন বাবদ অতিরিক্ত ফি আদায়ের পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষাবর্ষে এসএসসি ও জেএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ছাত্র-ছাত্রীদের সার্টিফিকেট (বিনামূল্য) প্রদানে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা করে আদায় করছেন।
জানা যায়, প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক শহিদুল ইসলাম স্কুল থেকে অবসরে যাওয়ার পর ২০১৯ সালেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান বর্তমান প্রধান শিক্ষক সানজিদা ইসলাম।
দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে সানজিদা ইসলাম প্রতি বছরের জানুয়ারি মাসে শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি ও সেশন ফিসহ বিভিন্ন খাতের লাখ লাখ টাকা নানা অজুহাতে আদায় করেছেন।
জানা গেছে কবি নজরুল শিক্ষা মঞ্জিলের নামে কাথুলি মৌজার ১৭৩ নং খতিয়ানের ২, ৩, ৫, ১৭, ১৮, ১৯, ২০, ২১, ২২, ৪, ৬ ৭ নং দাগে ৩৭.৯৬ একর বা ১১৫ বিঘা জমি রয়েছে। এর মধ্যে ৩০ শতক জমিতে একটি ও ১.২৮ একর জমিতে অপর একটি পুকুর, ৬ শতক জমিতে একটি মন্দির ও ১.২৬ একর জমি ভিটা। স্থানীয়দের হিসেব মতে কবি নজরুল শিক্ষা মঞ্জিলের ওই জমির বর্তমান বাজার দর ২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকা।
এই ১১৫ বিঘা জমি থেকে প্রতি বছরে বিঘা প্রতি ১০ হাজার টাকা পেলেও ১১ লাখ টাকা পাওয়া যায় লিজ বাবদ।
কাথুলি গ্রামের আফছুল হক জানান, প্রতি বছর ১০ হাজার টাকা লিজ হিসেবে ১৭ কাঠা জমি আমি চাষ করি। এর আগে লিজের অংক কম থকলে এখন এই হিসেবেই দেওয়া লাগে। এই মাঠের জমি সব্জী আবাদের জন্য প্রসিদ্ধ বলে চাহিদাও প্রচুর।
হেলাল উদ্দীন বলেন, আমি কবি নজরুল শিক্ষা মঞ্জিলের ১ বিঘা জমি লিজ নিয়েছি। এই জমি দীর্ঘদিন যাবৎ চাষ করি। বিঘা প্রতি বাৎসরিক ১০ হাজার টাকা লিজ খরচ দিতে হয় বলে জানান তিনি। বছরে দুই বার স্কুলের শিক্ষকরা এসে প্রতি বছর লিজের টাকা নিয়ে যান।
ওই গ্রামের ছমির আলী বলেন, প্রায় ২০/২৫ বছর ধরে ২ বিঘা জমি লিজ/ বর্গা নিয়ে চাষ করছি। কয়েক বছর থেকে বাৎসরিক ১০ হাজার টাকা দিতে হচ্ছে।
গ্রামের রুস্তুম আলী ২২ কাঠা জমি চাষ করেন। তিনি বলেন, এই মাঠে বাৎসরিক ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা দিয়ে ১ বিঘা জমি লিজ নিতে হয়। সেইক্ষেত্রে কবি নজরুল শিক্ষা মঞ্জিলের জমি বাৎসরিক ১০ হাজার টাকায় পাওয়া যায়। তাই এই জমির চাহিদা বেশ আছে।
নবম ও দশম শ্রেনীর কয়ক জন শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, শহীদ আব্দুল হামিদ নামের কারোর নাম শুনিনি কখনো। স্কুলের ফিল্ডের পাশে একটি ভাঙাচুরা কবর আছে দেখেছি। কিন্তু কবরটি কার তা বলতে পারবো না।তারা আরো বলে, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের কোনো গল্পও কখনো শোনাননি স্যাররা।
টয়লেটের পাশে একটি শহীদ মিনার থাকলেও কোনো দিবসে সেখানে কোনো কিছু করা হয়না। জাতীয় দিবসও দায়সারাভাবে পালন করা হয় বলে জানায় এসব শিক্ষার্থী।
মেহেরপুর পৌরসভার ৭ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর, শহীদ পরিবারের সন্তান নুরুল আশরাফ রাজীব বলেন, নজরুল শিক্ষা মঞ্জিলটি শিক্ষা এবং অন্যান্য কোনো কিছুতেই সামনের দিকে এগুতে পারিনি। আমি যতটুকু তাদের পরীক্ষার ফলাফল সমন্ধে জানি, অত্যন্ত খারাপ। শহীদ মিনার এবং একজন শহীদের কবর এত অবহেলিত। যেটা ভাবলেই শরীর শিউরে ওঠে। ওই বিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষকদেরই নৈতিক কোনো চেতনা নেই বলেই মনে হয়।
মেহেরপুর সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল আমিন ধুমকেতু বলেন, একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একজন শহীদের কবর অবহেলায় পড়ে থাকা খুবই দু:খজনক। আমি স্কুল কর্তৃপক্ষকে এবং একই সাথে জেলা প্রশাসনকে অনুরোধ করবো শহীদ হামিদের কবরটি পাকাকরণ করার জন্য।
মেহেরপুরের মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও গাংনী উপজেলা সমাজ সেবা অফিসার মাহাবুবুল হক মন্টু বলেন, শহীদ মিনার ও একজন শহীদের কবর যেভাবে অবহেলায় পড়ে আছে। এ ধরনের অবহেলা অত্যন্ত দু:খজনক। এটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থি। বিষয়টি আমি নিজেও ওই প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষকে বলেছি। কিন্তু তারা কোনো পদক্ষেপ নেইনি। বিষয়টি স্কুল কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট যারা রয়েছেন সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সানজিদা ইসলাম বলেন, আমি ২০১৯ সালে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার সময় চেয়ার, টেবিল বেঞ্চ পর্যন্ত ছিলনা। আমি আসার পর বিদ্যালয়ের যতটুকু উন্নয়ন দেখা যাচ্ছে সেটা করেছি। টয়লেটের পাশে শহীদ মিনার প্রসঙ্গে বলেন, এটা তো আগের কমিটি ও প্রধান শিক্ষকের সময় নির্মাণ করা হয়েছে। আপনারা সাংবাদিকরা এটি আগে দেখেননি কেনো ? আমি কমিটির সাথে মিটিং করে এর সমাধান করবো। এছাড়া শহীদ হামিদের কবর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি তার পরিবারের কাছে শহীদ হামিদের মুক্তিযুদ্ধের কাগজপত্র চেয়েছি। তার পরিবারের পক্ষ থেকে কাগজপত্র দিয়ে সহযোগীতা করেনি। যার কারণে, কবরটি বাঁধা সম্ভব হয়নি। প্রধান শিক্ষক নিজে শহীদ পরিবারের সন্তান দাবী করলেও সকল শহীদের মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নেই এমন কথা শোনেননি বলে জানান তিনি।
বিদ্যালয়ের ১১৫ বিঘা জমি আছে উল্লেখ করে প্রধান শিক্ষক বলেন ১১৫ বিঘা জমির মধ্যে ৮০ বিঘা জমি স্থানীয়দের কাছে লিজ দেওয়া আছে। সেখান থেকে বছরে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকার মত লিজের টাকা পাওয়া যায়। সে টাকায় বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতনভাতা দেওয়া হয়। যদিও বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের স্কুলের বেতন এক বছর দেওয়া সম্ভব হয়নি। বিদ্যালয়ের জমির লিজের টাকা থেকে বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককে ৬ হাজার ও একজনকে ৫ হাজার টাকাসহ জৈষ্ঠতার ভিত্তিতে ২ হাজার থেকে শুরু করে শিক্ষক কর্মচারীদের প্রতি মাসে ৭২ হাজার টাকা দিতে হয়। বিদ্যালয়ে ৩১০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৮৫ জন ছাত্রী রয়েছে। তবে, করোনার কারনে বিগত বছরে অনেক শিক্ষার্থী ঝরে গেছে বলেও জানান প্রধথান শিক্ষক।
বিদ্যালয়ের নবম ও দশম শ্রেনীর শিক্ষার্থীর মাসিক বেতন ২০০ টাকা, অষ্টম শ্রেনীর ১৫০ টাকা ও ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেনীর বেতন ১২০ টাকা বলে জানান তিনি।তবে, শিক্ষার্থীদের বেতন থেকে কতটাকা আয় হয় সেটা জানাতে পারেননি।
বিদ্যালয়ের নিয়মিত অভ্যন্তরিন মিটিং এ সকল ধরণের অর্থনৈতিক হিসাব নিকেশ পাশ করিয়ে নেয়া হয়। এছাড়া ২০১৯ সালে মন্ত্রণালয়ের অডিট হয়েছে বলে জানান তিনি।
সানজিদা ইসলাম আরো বলেন, বিদ্যালয়ের পরিচালনার জন্য একটি ব্যবস্থাপনা কমিটি রয়েছে। আমি একা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারিনা। সেই কমিটির মাধ্যমেই বিদ্যালয়ের উন্নয়নসহ সব ধরণের কার্যক্রম হাতে নেয়া হয় এবং সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হয়। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী বর্তমান কমিটির সভাপতি উল্লেখ করে তিনি বলেন, সামনের মিটিং এ শহীদ মিনার এবং শহীদ হামিদের কবরের ব্যাপারে আলোচনা করবো।
তবে, বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক বলেন ২০১৯ সালের মন্ত্রণালয়ের অডিটের একটি কপি তাদেরও প্রয়োজন।