কিছুতেই বিপদ পিছু ছাড়ছে না বাংলাদেশের জীববৈচিত্রের সবচেয়ে বড় আধার সুন্দরবনের। একদিকে চোরা শিকারিদের হাতে মারা পড়ছে জঙ্গলের বাঘ, হরিণসহ বিভিন্ন প্রাণী, অন্যদিকে থেমে নেই বনটির অভ্যন্তরে নদীর পানিতে বিষ দিয়ে মাছ নিধন।
এর মধ্যে যোগ হয়েছে একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। গেল ২০ বছরে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগে ২২ বার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
প্রতিবার এর কারণ অনুসন্ধান, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ ও ভবিষ্যতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তবে সেসব তদন্তের প্রতিবেদন ও দুর্ঘটনা এড়াতে করা সুপারিশগুলো বাস্তবায়তি হতে দেখা যায়নি।
জানা যায়, শুধু আগুনেই পুড়ছে না সুন্দরবন। বন্যপ্রাণী ও মৎস্য সম্পদই ধ্বংস করে চলছে প্রতিনিয়ত একশ্রেণির চক্র।
অত্যাধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর ‘স্মার্ট পেট্রোলিং’ আর জেলে-বনজীবীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে বাঘ, হরিণ হত্যাসহ বনের সম্পদ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা যাচ্ছে না। এই অবস্থার মধ্যে অক্সিজেনের অফুরন্ত ভাণ্ডার দেশের ফুসফুসখ্যাত ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সুন্দরবন এখন অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে সুন্দরবনে আয়তন ছিল বর্তমানের দ্বিগুণ। কমতে-কমতে বর্তমানে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন এখন দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার।
যা দেশের সংরক্ষিত বনভূমির সর্বমোট ৫১ ভাগ। ২৪ ঘণ্টায় দুবার সমুদ্রের জোয়ারের লবণাক্ত পানিতে প্লাবিত হয় সুন্দরবন।
সংরক্ষিত এই বনের তিনটি এলাকাকে ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের ইউনেসকো ৭৯৮তম ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইট ঘোষণা করে। বর্তমানে যা সমগ্র সুন্দরবনের ৫২ ভাগ এলাকা।
এখানে সুন্দরী, গেওয়া, গরান, পশুরসহ ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদরাজি রয়েছে। এছাড়া ৩৭৫ প্রজাতির বন্য প্রাণীর মধ্যে রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও হরিণসহ ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, লোনা পানির কুমির, গুইসাপ, কচ্ছপ, ডলফিন, অজগর, কিংকোবরাসহ ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ ও ৩১৫ প্রজাতির পাখি রয়েছে।
সুন্দরবন ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইটের পাশাপাশি বিশ্বের বৃহত্তর জলাভূমিও। সুন্দরবনের জলভাগের পরিমাণ এক হাজার ৮৭৪ দশমিক এক বর্গ কিলোমিটার। যা সমগ্র সুন্দরবনের ৩১ দশমিক ১৫ ভাগ।
১৯৯২ সালে সমগ্র সুন্দরবনের এই জলভাগকে রামসার এলাকা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ। এছাড়া সুন্দরবনের সমুদ্র এলাকার পরিমাণ এক হাজার ৬০৩ দশমিক দুই বর্গ কিলোমিটার।
এই জল ভাগে ৪৫০টি ছোট-বড় নদী ও খালে রয়েছে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির ইরাবতীসহ ৬ প্রজাতির ডলফিন, ২১০ প্রজাতির সাদা মাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া, ৪৩ প্রজাতির মলাস্কা ও এক প্রজাতির লবস্টার।
ইতিমধ্যেই সুন্দরবন থেকে হারিয়ে গেছে এক প্রজাতির বন্য মহিষ, দুই প্রজাতির হরিণ, দুই প্রজাতির গণ্ডার, এক প্রজাতির মিঠা পানির কুমির।
করোনাকালে গত ২৬ মার্চ থেকে ৫ নভেম্বর পর্যন্ত গোটা সুন্দরবনে সর্বোচ্চ সর্তকতা ‘রেড অ্যালার্ট’ জারি করে পর্যটক, জেলে-বনজীবীদের সুন্দবনে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে বন অধিদপ্তর। এই নিষিদ্ধ সময়ের মধ্যেও হুমকিতে পড়ে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বনটিতে ২০০২ সালে শরণখোলা রেঞ্জের কটকা অভয়ারণ্য এলাকায়, ২০০৪ সালে চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের নাংলী ক্যাম্প এলাকায় এবং আড়ুয়াবের খালে, ২০০৫ সালে চাঁদপাই রেঞ্জের আড়ুয়াবের খালের পশ্চিমে তুলাতলা ও খুটাবাড়ি এলাকায় আগুন লাগে।
এরপরের বছর ২০০৬ সালেই তেরাবেকা খালের পাড়ে, আমুরবুনিয়া, কলমতেজিয়া, পচাকুড়ালিয়া বিল ও ধানসাগর স্টেশন এলাকায় মোট ৫টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
২০০৭ সালে বলেশ্বর নদীর তীরবর্তী নলবন, পচাকুড়ালিয়া বিলে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। ২০১০ সালে ধানসাগর স্টেশনের গুলিশাখালী, ২০১১ সালে ধানসাগর স্টেশনের নাংলী, ২০১৪ সালে আবারও ধানসাগর স্টেশন সংলগ্ন বনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
২০১৬ সালেও ধানসাগর স্টেশনের নাংলী, পচাকুড়ালিয়া, তুলাতলী এবং ২০১৭ সালে একই স্টেশনের মাদরাসার ছিলা নামক স্থানে আগুন লাগে। সর্বশেষ ২০২১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি আবারও ধানগারস স্টেশন এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে প্রায় চার শতক বনভূমি পুড়ে যায়।
২০০২ সালের ২২ মার্চ থেকে থেকে ২০২১ সালে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গত ২০ বছরেও সুন্দরবনে ২২ বার অগ্নিকাণ্ড লাগে। এসব অগ্নিকাণ্ডে সুন্দরবনের ৭১ একর ৭০ শতাংশ বনভূমির গাছ, বিভিন্ন প্রকার ঘাস, লতাপাতা পুড়ে যায়। যার আর্থিক মূল্য ১৮ লাখ ৫৫ হাজার ৫৩৩ টাকা।
প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের পরে আগুনের কারণ, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ ও পরবর্তীতে এ ধরণের ঘটনা এড়াতে গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটি নির্দিষ্ট সময়ে সুপারিশসহ রিপোর্টও পেশ করে। তবে সেসব রিপোর্টের প্রতিফলন বাস্তবে দেখা যায়না। থেকে যায় ফাইলবন্দি।
অগ্নিকাণ্ড এড়াতে বিভিন্ন সময় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে জোরালোভাবে তিনটি সুপারিশ করা হয়।
সুপারিশ তিনটি হচ্ছে- সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয়ের সাথে মিশে যাওয়া নদী ও খাল খনন, অগ্নিকাণ্ডপ্রবণ এলাকায় প্রতি দুই কিলোমিটার পরপর ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করে নজরদারির ব্যবস্থা করা, চাঁদপাই রেঞ্জের ভোলা নদীর কোল ঘেঁষে বনের পাশ দিয়ে কাঁটাতার অথবা নাইলোনের রশির নেট দিয়ে বেড়া দেওয়ার ব্যবস্থা করা। কিন্তু তিনটির একটি সুপারিশও বাস্তবায়ন হয়নি।
সেভ দ্যা সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবনকে আগুন থেকে রক্ষা করার জন্য লোকালয়সংলগ্ন নদী-খাল খনন ও কাটা তারের বেড়া দেওয়া খুবই জরুরি। এছাড়া বন অপরাধীদের দৌরাত্ম্য রোধে বনরক্ষীদের তৎপরতা বৃদ্ধি করতে হবে। অসাধু বন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ারও দাবি জানান তিনি।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, সুন্দরবনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করা বনজীবীদের বিড়ি সিগারেটের আগুনে অনেক সময় আগুন লাগে। এজন্য আমরা বনজীবী ও স্থানীয়দের সচেতন করেছি। সচেতনতামূলক কার্যক্রম এখনও অব্যাহত রয়েছে। তদন্ত কমিটির যে সুপারিশে যে ওয়াচ টাওয়ার করার সুপারিশ ছিল।
বন বিভাগের একটি প্রজেক্টে ওয়াচ টাওয়ার করার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রজেক্টটি পাস হলে আমরা টাওয়ার করব। টাওয়ার হলে আগুনের স্থান নির্ধারণ সহজ হবে। সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকার ভরাট হওয়া নদী ও খাল খননের বিষয়েও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাঘ, হরিণ হত্যার পাশাপাশি খালে বিষ দিয়ে মাছ শিকার ও আগুন দস্যুদের হাত থেকে সুন্দরবন রক্ষায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর স্মার্ট পেট্রোলিংসহ সব ধরনের পাহারা জোরদার করা হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।