দিন আসে দিন যায় মাস পেরিয়ে আসে নতুন কোন বছর। আবার সে সবই জাগতিক নিয়মে বিলিন হয় মহা অতিতের গর্ভে। ধারাবাহিক সে সময়ের মধ্যে এমন কিছু ক্ষণ, সময় বা ঘটনা হৃদয়ে দাগ কেটে যায় যা কখনো ভুলে যাবার নয় বিস্তৃতি হবার নয়। সে স্মৃতিগুলো বার বারই হৃদয় পটে ভেসে ওঠে ধ্রুপদী চলচিত্রের মতো। এমনই একটি শৈশব স্মৃতি যা আমাকে কখনো হাসায় আবার কখনো বা গভীর বেদনায় কাঁদিয়ে যায়। অনেক চেষ্টা করেও জীবনের পাতা থেকে বাদ দিতে পারিনি সেই স্মৃতি।
মেহেরপুর জেলার মুজিবনগর উপজেলায় সীমান্তবর্তী একটি গ্রামে আমার জন্ম। শৈশব এর কথা মনে পড়তে স্মৃতিপটে ভেসে আসে বাড়ির উঠোনে চাঁদের আলোয় দাদির পাশে বসে গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তাম। কিন্তু হঠাৎ করেই জীবন থেকে মিলিয়ে গিয়েছিলো সেইসব মধুর সময়। কিছুদিন থেকেই গ্রামের মানুষের মুখে মুখে শুনছিলাম যে কোন সময় গ্রামে মিলটারি আসতে পারে। দুদিন হলো মেহেরপুর শহরের প¦ার্শবর্তী গ্রাম গোভীপুর থেকে ফুফুদের বাড়ির সবাই আমাদের বাড়িতে এসে আশ্রয় নিয়েছে। আমার এক চাচা আনসার বাহিনীর সদস্য ছিলেন তিনি তার চাকুরি ছেড়ে চলে এসেছেন। আমাদের সতর্ক করে বললেন এখানে থাকা আর নিরাপদ হবে না প্রয়োজনে ভারতে চলে যেতে হবে। আমি লক্ষ করছিলাম দেশের ভিতর থেকে অনেক মানুষ পায়ে একেবারে হেটে ভারতে পালানোর নিমিত্তে গ্রামের পথ ধরে সীমান্তের দিকে এগিয়ে চলেছে। তাদের কষ্ট দেখে আমার কান্না পাচ্ছিলো।
দিনটি আমার ঠিক ঠিক মনে পড়ে না তবে ২৫ অথবা ২৬ মার্চ ১৯৭১ হঠাৎ করেই পাকিস্তানি মিলিটারিদের একটি হেলিকপ্টার এই এলাকার আকাশে ঘুরে ঘুরে উড়ে চলছিলো। এতখানি নিচু দিয়ে হেলিকপ্টার চলা জীবনে আমার প্রথম দেখা। দ্রুত আতংকে গ্রামের সর্ব সাধারন পালাতে লাগলো। পার্শবর্তী মাঠের দিকে কোন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। বিশেষ করে মেয়েদের সরিয়ে নেওয়া হচ্ছিলো। শোনা গিয়েছিলো পাকিস্তানি মিলিটারিরা মেয়েদের সম্মানহানিসহ যেকোন অত্যাচার করতে দ্বিধা করে না। ঠিক ঐ সময় আমি পাশেই নদীতে গোসল করতে গিয়েছিলাম। এসেই দেখি আমাদের বাড়ির কেউ নেই শুধু আমার বাবা আমার জন্য অপেক্ষা করছিলো। আমাকে পাবার পর আমাকে সাথে নিয়ে দৌড়াতে লাগলো। পরক্ষনেই তথাকথিত মিলিটারি নামক পাক হানাদার বাহিনী দাপটে প্রবেশ করেছিলো গ্রামে। অস্ত্র হাতে তারা নিরীহ জনগনের ওপর চালিয়ে ছিলো অত্যাচার। মহুর্তে যারা ঘর থেকে পালাতে পারেনি এমন মেয়েদের ওপর তারা চালিিেছলো পাশবিক নির্যাতন।
মনে পড়ে সেদিনই বাড়ি থেকে আমরা রওনা হয়েছিলাম প¦ার্শবর্তী দেশ ভারতের উদ্দেশ্যে। বাড়ি থেকে একটি গরুর গাড়িতে নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু দ্রব্য চাপিয়ে দিয়ে দূর্দাশাগ্রস্ত কাঁচা ও কর্দমাক্ত রাস্তা পায়ে হেটে হেটে অতিক্রম করে কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে আগত সন্ধ্যার আধারে পৌছালাম একেবারে সীমান্ত রেখার সন্নিকটে বাজিতপুর নামক গ্রামে। যে গ্রামটি আমার জীবনের অচেনা এক জগৎ ছিলো। সেই রাতের অচেনা অন্ধকারে সেই গ্রামের রুপ বর্ণনা করা আমার আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এমনকি আজ জীবনের এই সন্ধিক্ষনে এসেও বহুবার চেষ্টা করেও পারিনি মিল করতে। শুধু মনে পড়ে আমার বাবার দুর সম্পর্কের কোন আত্মিয়ের বাড়িতে উঠেছিলাম। তাদের বাড়ির স্বল্পপরিসরে যারপরনায় আন্তরিকতার সাথে তারা ঠায় করে দিয়েছিলো ক্লান্ত অবসাদ মাখা মানুষগুলোকে একটি রাত্রি যাপনের জন্য। আমার ফুপাদের পরিবারসহ আমাদের পরিবারের লোকজন এবং যথারিতি তাদের পরিজন মিলে এক নঙর খানার মতো সৃষ্টি হয়েছিলো সে রাতে।
শেষাবধি আমি এবং আমার এক ফুপাতো ভাই গরুর গাড়ির নিচে বিচালী বিছিয়ে শয়ন করেছিলাম, কিন্তু বিধিবাম দৈবাৎ শুরু হলো প্রকৃতির পাগলামি আকাশ জুড়ে মেঘ, শুরু হলো বৃষ্টি ঘুম ভেঙ্গে গেলো। আমাদের পাশেই ছিলো অপরিচ্ছন্ন খুঁদে একটি রান্না ঘর। আমার ফুপাতো ভাইটি আমার তুলনায় বয়সে বড় ছিলো সে কারনে বুদ্ধিও তার আমার চেয়ে বেশি থাকার কথা। তারই নির্দেশনায় শেষমেষ ঐ রান্নাঘর নামক জায়গাটিতে ঢুকে পড়লাম। কিন্তু সেখানে ছিলো একটি কুকুর শুয়ে। মনে হলো আজন্ম ঐ জায়গাটি তারই। আমার ফুপাতো ভাইয়ের অত্যাধিক প্রচেষ্টায় কুকুরটিকে অপসারিত করা গিয়েছিলো জায়গা হতে। আমরা ও আমাদের অবসাদক্লিষ্ট শরীরটা এলিয়ে দিয়েছিলাম সেখানে। আবারো চোখের পাতায় ভর করেছিলো ঘুম। সকালে নিদ্রা ভঙ্গ হলে দেখি কুকুরটা আমাদের পাশেই শুয়েছিলো।
লেখক: কবি ও সাহিত্যিক